Print Date & Time : 17 June 2025 Tuesday 11:58 am

করের টাকা কর্মকর্তা কর্মচারীর ‘পকেটে’

নজরুল ইসলাম:দেশের উন্নয়নের জন্য কর দেন করদাতারা। সেই করের টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হবে, এটাই স্বাভাবিক। সে জন্য রয়েছে কর অঞ্চলের নির্ধারিত কোড নম্বর। কিন্তু সেই কোড নম্বরে করদাতাদের দেয়া টাকা জমা হয়নি। জমা হয়েছে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যাংক হিসাবে। সেই হিসাব থেকে উত্তোলন করে মিলেমিশে আত্মসাৎ করেছেন কর্মকর্তা-কর্র্মচারীরা। রক্ষক হয়ে এমন ভক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন রংপুর কর অঞ্চলের একটি সার্কেলের তিন কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের সঙ্গে আত্মসাতে শরিক হয়েছেন আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত একজন কর্মচারী। করের টাকা আত্মসাতের চারজন জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাদের বিরুদ্ধে আদালতে সম্প্রতি চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করা হয়েছে।

চার্জশিটভুক্ত এই চার আসামি হলেনÑরংপুর কর অঞ্চলের সার্কেল-৮-এর প্রধান সহকারী আব্দুল মজিদ, সাঁট মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ওবাইদুর রহমান, অতিরিক্ত সহকারী কর কমিশনার বর্তমানে সার্কেল-৫ (সৈয়দপুর-১)-এর সহকারী কর কমিশনার গোবিন্দ চন্দ্র দাস ও আউটসোর্সিংয়ে কর্মরত আতিকুর রহমান আশিক ওরফে আতিক। চার্জশিটটি দাখিল করেছেন দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ জিন্নাতুল ইসলাম। দুদক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।

সূত্রমতে, সরকারি খাতে জমা না করে করের টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার ঘটনায় ২০১৯ সালের ২০ মে রংপুর কর অঞ্চলের সার্কেল-৮-এর সহকারী কর কমিশনার নাজনীন আকতার নিপা বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮, ৩৪ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় মামলাটি দায়ের করা হয়। দিনাজপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলাটি রেকর্ড করেন পরিদর্শক বজলুর রশিদ।

দুদকের দেয়া চার্জশিটে বলা হয়েছে, আটটি পে-অর্ডারে করদাতারা ২৬ লাখ ৬২ হাজার ১১৮ টাকা পরিশোধ করেন। সেই টাকা সরকার-নির্ধারিত কোড নম্বরে (১-১১৪১-০০৬৫-০১১১) জমা না করে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও জালিয়াতি করে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যাংক হিসাবে (১৮০৯৩৩৩০০১৯৬৪) জমা করা হয়। পে-অর্ডারগুলো ঘষামাজা করা হয়। পরে তিনটি চেকের মাধ্যমে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়, যা দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০, ৪৬৫, ৪৬৭, ৪৬৮, ৩৪, ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধ। তবে করদাতা রুমানা ইয়াসমিনের এক লাখ ৯৮ হাজার ৭৩৬ টাকা, গোপী কিষাণ চৌধুরীর (লক্ষ্মী ভাণ্ডার) এক লাখ ৫০ হাজার ৬৭০ টাকা, অঞ্জন দত্তের সাত লাখ ৫২ হাজার ২৪৮ টাকাসহ মোট ১১ লাখ এক হাজার ৬৫৪ টাকা সোনালী ব্যাংক দিনাজপুর করপোরেট শাখায় জমা আছে। জালিয়াতি উদ্ঘাটনের কারণে টাকাগুলো ক্লিয়ারিং করা হয়নি।

তদন্তকালে দেখা যায়, সোনালী ব্যাংক দিনাজপুর করপোরেট শাখায় দুটি পে-অর্ডারে গোবিন্দ চন্দ্র দাস একবার ছয় লাখ, আরেকবার পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকাসহ মোট ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করেন। কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ পাঁচ লাখ ৬০ হাজার টাকা বাহক হিসেবে ‘নিরেন চন্দ্র দাস’ লিখে নিজেই সই করে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যাংক হিসাব থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। ২০১৮ সালের ৩ জুন একটি চেকের মাধ্যমে ৯২ হাজার ৭৮৪ টাকার সামনে একটি সংখ্যা ৬ (ছয়) বসিয়ে ছয় লাখ ৯২ হাজার ৭৮৪ টাকা উত্তোলন করেন।

দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুল মজিদ জানিয়েছেন, চার লাখ ৫৬ হাজার ৭৭০ টাকা লেখা চেকে তিনি ৫৬ হাজার ৭৭০ টাকা লিখে উত্তোলনের জন্য তিন নম্বর আসামি আতিকুর রহমান আশিক ওরফে আতিককে দেন। উত্তোলন করে আতিক সেই দিনই তাকে ৫৬ হাজার ৭৭০ টাকা বুঝিয়ে দেন। ছয় লাখ ৯২ হাজার ৭৮৪ টাকা লেখা চেকে তিনি ৯২ হাজার ৭৮৪ টাকা লিখে বাহক ওবাইদুর রহমানকে দেন। উত্তোলন করে ওবায়দুর তাকে ৯২ হাজার ৭৮৪ টাকা বুঝিয়ে দেন। এতে প্রমাণ হয়, চেক দুটিতে অতিরিক্ত চার লাখ ও ছয় লাখ টাকা উত্তোলনে আতিক ও ওবাইদুর জড়িত।

তদন্তে আরও জানা গেছে, করদাতাদের দেয়া আয়করের পে-অর্ডারগুলো নিয়ম অনুযায়ী সোনালী ব্যাংক দিনাজপুর করপোরেট শাখার সাবসিডিয়ারি শাখার একজন কর্মচারী গ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে সাবসিডিয়ারি শাখার কর্মচারী যাচাই-বাছাই করার সুযোগ নেই। মামলা তদন্তকালে দেখা যায়, উপকর কমিশনার কার্যালয়ের অনুকূলে ইস্যু হওয়া সোনালী ব্যাংক দিনাজপুর করপোরেট শাখায় দুটি পে-অর্ডারে ৭৮ হাজার ২৯০ ও দুই লাখ ১৬ হাজার ৩৭৫ টাকা এবং সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংক (এসবিএসি) দিনাজপুর শাখায় একটি পে-অর্ডারে এক লাখ পাঁচ হাজার ৭৯৯ টাকা জমা করা হয়। পে-অর্ডার তিনটির উল্টো পিঠে কর অফিসের সিল ও কোড নম্বর ১-১১৪১-০০৬৫-০১১১-এর স্থলে ঘষামাজা করে কর্মচারীদের বেতন-ভাতার ব্যাংক হিসাব নম্বর বসিয়ে দেয়া হয়। ঘষামাজা করে ব্যাংক হিসাব নম্বর বসিয়ে দেয়ার বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা উদ্ঘাটন করেছেন। এই ঘষামাজার সঙ্গে আতিকের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে দুদক। দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি তা স্বীকারও করেছেন। জবানবন্দিতে তিনি জানিয়েছেন, আসামি আব্দুল মজিদ ও ওবাইদুরের প্ররোচনায় আতিক এসব করেছেন। এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, জালিয়াতিতে আব্দুল মজিদ, ওবাইদুর ও আতিক সরাসরি জড়িত। তদন্তকালে সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় সোনালী ব্যাংক দিনাজপুর করপোরেট শাখার কর্মকর্তা (হিসাব) হাবিব, রংপুর কর অঞ্চলের সার্কেল-৯-এর আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত নিরেন চন্দ্র রায় ও রংপুর কর অঞ্চলের সার্কেল-৮-এর আউটসোসিংয়ের মাধ্যমে অফিস সহকারী আক্তারুজ্জামান ওরফে আপেলকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সহকারী কর কমিশনার গোবিন্দ চন্দ্র দাস শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমাদের স্টাফরা এসব করেছে। চার্জশিট দাখিলের বিষয়টি আমি অবগত নই।’ অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ওবাইদুর রহমানের মোবাইল ফোন নম্বরে কল করা হলে তিনি রিসিভ করেননি।