নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনায় কিছু শিল্প-কারখানা সচল। তবে অর্থনীতি সেই অর্থে সচল নেই। তবে দেশের উন্নয়ন ও ব্যয় নির্বাহের জন্য রাজস্ব প্রয়োজন। সেজন্য বেশি বেশি রাজস্ব আহরণে ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে আগের মতোই কর, ভ্যাট ও শুল্কে ছাড় আর ছাড় চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতিবছর বাজেটের আগে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সঙ্গে যৌথ পরামর্শক সভা করে এনবিআর। করোনার কারণে এবার ভার্চুয়ালি পরামর্শক কমিটির ৪১তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। গতকাল এ পরামর্শক সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। সঞ্চালনা করেন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। সভায় দেশের ব্যবসায়ী, অ্যাসোসিয়েশন ও চেম্বারের সভাপতি এবং অন্য নেতারা বক্তব্য রাখেন।
শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, ‘গত বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমেছে। এছাড়া সব আয়কর কমেছে। ভ্যাটে আমরা রেট ট্যারিফ কমানোর অনুরোধ করেছিলাম। সেটা ওই সময় সম্ভব হয়নি। করনেট বৃদ্ধির করার অনেক সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে ট্যারিফ রেট, এটি, এআইটি বিলুপ্ত এবং ধারাবাহিকভাবে হ্রাস করে একদম বিলুপ্ত করার অনুরোধ রইল।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের হিডেন চার্জ যেন না আসে। এআইটি তিন বছরের জন্য আমরা বিলুপ্ত করার অনুরোধ করেছিলাম। কারণ রেয়াত নেয়ায় জটিলতা আছে। এআইটি আগামী দুই বছরের মধ্যে বিলুপ্ত করা, এটি, এআইটি এবছর যতটুকু সম্ভব কমানো, করপোরেট কর যতটুকু সম্ভব কমানো এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির করপোরেট কর ২৫ শতাংশ থেকে কমানোর সুপারিশ করেন তিনি। লকডাউন কোনো সমাধান নয়। এর ফলে আর্থিক, সামাজিক, মানসিক সব দিকে চাপ পড়ছে।’
সভাপতির বক্তব্যে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা একটি ব্যবসাবান্ধব রাজস্ব প্রশাসন তৈরি করতে চাই, যেখানে স্থানীয় শিল্পকে সহযোগিতা, ব্যবসার উন্নয়ন করা এবং অসচ্ছতা ও কর ফাঁকির জায়গাগুলো সংকুচিত করা হবে। এই লক্ষ্য নিয়েই এনবিআর কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে দেশের চাহিদা পূরণ, ব্যয় নির্বাহ ও উন্নয়নের জন্য রাজস্ব আহরণের বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। আমরা সবাই বিশ্বাস করি যে, করনেট বৃদ্ধি করলে করহার হ্রাস হলেই কর প্রদান সহজ হবে। এ নিয়ে এনবিআর কাজ করে যাচ্ছে। নন-কমপ্লায়েন্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এরই মধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। কর বাড়লে করপোরেট কর ভবিষ্যতে কমিয়ে আনা যাবে। অটোমেশনের মাধ্যমে আমরা ইজ অব ডুয়িং বিজনেসসহ অন্যান্য স্বচ্ছতার মধ্যে আছি।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, ‘আমি মনে করি, ব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানো দরকার। তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো মানে দেশকে শক্তিশালী করা। এটা দেশের স্বার্থে করতে হবে। ব্যবসায়ীদের সুযোগ দিলে একদিকে রাজস্ব আয় বাড়বে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে।’ মুস্তফা কামাল বলেন, জাতীয় বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি-দাওয়া বা চাওয়া যুক্তিসংগত, অযৌক্তিক কোনো চাওয়া থাকে না। তারা দেশের নিবিড় অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ব্যবসায়ীদের সুযোগ বাড়িয়ে দিলে দেশ উন্নত হয়।’ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া বাংলাদেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে বলে উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা যদি দেশকে উজাড় করে দেন, তাহলে ঠকবেন না। আপনাদের নিজের যেমন আয় বাড়বে, তেমনি দেশের কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া এই দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যেই আমরা ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই।’
বিজিএমইএ’র নবনির্বাচিত সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, পোশাকশিল্পের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হারিয়েছি ২০১৯-২০ অর্থবছরে। এবছর রপ্তানি ৩৪ বিলিয়ন থেকে ২৮ বিলিয়নে নেমেছে। শিল্প যখন ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছে, তখনই আবার করোনার প্রভাব পড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসের তুলনায় রপ্তানি হারিয়েছি সাড়ে ৯ শতাংশ। রপ্তানি সব পণ্য ও সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট মওকুফ ও রিটার্ন দাখিল থেকে অব্যাহতি দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি। পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর দশমিক ২৫ শতাংশ করা এবং তা আগামী পাঁচ বছরের জন্য কার্যকর রাখতে অনুরোধ করেন তিনি। করোনার ক্ষতি বিবেচনায় পোশাক খাতের বর্তমান করপোরেট কর আগামী পাঁচ বছর অব্যাহত রাখা, নগদ সহায়তার ওপর কর ১০ থেকে তিন শতাংশ করাসহ একগুচ্ছ প্রস্তাবনা দেন তিনি।
বিটিএমইএ’র সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন সব সুতার ওপর একই হারে ভ্যাট ধার্য এবং ক্যাপিটাল মেশিনারিজের মতো স্পেয়ার্স পার্টসেও একই হারে শুল্ককর করার সুপারিশ করেন।
সিলেট চেম্বারের সভাপতি আফজারুল রশিদ চৌধুরী বলেন, দেশের চা শিল্পকে ধ্বংস করতে একটি চক্র ও অসাধু ব্যবসায়ীরা চা আমদানি করছেন। এতে দেশীয় চা শিল্পের বাজার নষ্ট হচ্ছে। এছাড়া চা শিল্পে ব্যাংকঋণের সুদ কমানোর জন্য সুপারিশ করেন তিনি। বায়রার প্রেসিডেন্ট বেনজির আহমেদ বলেন, করোনা আর লকডাউনের কারণে কর্মী প্রেরণ বন্ধ। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে শিল্প হিসেবে ঘোষণা ও প্রণোদনা প্রয়োজন। নন-প্রফিট অরগানাইজেশন হিসেবে বায়নার ওপর আয়কর প্রত্যাহারের সুপারিশ করেন তিনি। ঢাকার বাইরের কয়েকটি খাতের ব্যবসায়ীরা টার্নওভারের ওপর ভ্যাট কমানো, সম্পদে সারচার্জ হার কমানো, এটি, আইটি কমানোসহ বেশ কিছু সুপারিশ করেন। সম্ভব হলে করোনার মধ্যে ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখার সুপারিশ করেন।