করোনাকালীন অনলাইন পড়াশোনা

শান্তনু শেখর রায়: বিশ্বব্যাপী এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। সম্পূর্ণ নতুন এক ভাইরাস পুরো পৃথিবীকে সংক্রমিত করে চলেছে, যার সঙ্গে এই শতাব্দীর মানুষের পূর্ব পরিচয় ছিল না। শিশু এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে এই সময়টা একটি শ্বাসরুদ্ধকর ও অপ্রত্যাশিত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। করোনা ভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯-এর তাণ্ডবে অফিস, আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শপিংমল, বিনোদনকেন্দ্রের পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যায় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিসিয়াল কাজকর্ম শুরু হলেও স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টি বিবেচনা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শ্রেণিকক্ষের পাঠদান যেমন বন্ধ রয়েছে, তেমনি শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।

সামান্থা ঢাকার বেসরকারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মে মাসের শুরু থেকেই তাদের অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। কখনও ফেসবুক লাইভ কিংবা জুম ব্যবহার করে শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিচ্ছেন। ক্লাসে অংশ নিতে মায়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে সামান্তা। দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত অনলাইনে প্রতিদিন এভাবেই ক্লাস করতে হচ্ছে তাকে।

ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি বিশেষ করে সুপরিচিত স্কুলগুলোতে গত দুই-তিন মাস ধরেই এমন শিক্ষাচর্চা চলছে। করোনাভাইরাসের কারণে সরকার গত মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর ঈদসহ নানা ছুটির কারণে মে মাস থেকেই অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার কাজ শুরু করে অনেক স্কুল। ঢাকার বাইরেও চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, যশোরসহ বড় শহরগুলোতে এ ধরনের অনলাইন শিক্ষাদান কর্মসূচি চালু করেছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের চেয়ে বেসরকারি স্কুলগুলো বিশেষ করে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলগুলো ফেসবুক বা জুম ব্যবহার করে অনলাইন পাঠদান শুরু করেছে আগে থেকেই। সরকারি স্কুলগুলোতে অনলাইনের চেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে সংসদ টিভির মাধ্যমে স্কুলের সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদান প্রক্রিয়াকে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হবে। দীর্ঘ সময় এই অস্বাভাবিক বিরতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি তারা মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। অভিভাবক এবং বিশ্লেষকদের মতে, সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে প্রাথমিক পর্যায়ের শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর। এ সময়ে পড়াশোনার পাশাপাশি শিশু শিক্ষার্থীরা সামাজিকতাও শেখে। তাই স্কুলের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল শিশুদের কাছে আনন্দের জায়গা। স্কুলে ওরা লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা, সহপাঠীদের সঙ্গে মনের ভাব আদান-প্রদান করে। স্কুল থাকলে শিশু শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ে স্কুলে যাওয়া, ফিরে আসা এবং বাসায় সময়মতো পড়তে বসার বিষয়গুলো রুটিনমাফিক চলে। করেনাকালীন শিশুরা অলস সময় পার করছে অনেকে লেখাপড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশু শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী আজ গৃহবন্দি। অনেক পরিবারে যাদের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি পুরুষ, করোনাকালীন উপার্জন কমে গেছে তারা স্কুল অথবা কলেজপড়–য়া সন্তান-স্ত্রীসহ গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধার অভাব রয়েছে। দীর্ঘদিন শহরের চার দেয়ালে বন্দি থাকা শিশুরা গ্রামের খেলামেলা পরিবেশে গিয়ে লেখাপড়ার মনোনিবেশ করতে পারছে না।

অনলাইন ক্লাস ডিজিটাল পদ্ধতি। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে থেকেই অনলাইন ক্লাস পদ্ধতি চালু আছে, যেখানে সারা বিশ্ব থেকে যে কেউ ফি প্রদানের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে অংশগ্রহণ করতে পারে। আমাদের দেশেও বাংলাদেশ উš§ুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দূর শিক্ষণ নামে শিক্ষা পদ্ধতি চালু আছে। সম্প্রতি রবি মোবাইল কোম্পানি ‘টেন মিনিট স্কুল’ চালু করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রবি টেন মিনিট স্কুল বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অনলাইন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রতিদিন প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থীকে ওয়েবসাইট, ফেসবুক ও অ্যাপের মাধ্যমে বিনামূল্যে শিক্ষা দান করা হয়।

অনলাইন ক্লাসের জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী সবার জন্য দরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট পরিসেবা। সঙ্গে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা সমপর্যায়ের অন্য কোনো ডিভাইস। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বেশিরভাগ শিক্ষকের এই উপকরণ থাকলেও গ্রামের প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে অনেক শিক্ষকের কাছে এগুলো হয়তো নেই। শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও একই প্রস্তুতি থাকতে হবে। গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের অনেকের কাছেই স্মার্টফোন নেই। আবার কারও স্মার্টফোন আছে কিন্তু ইন্টারনেটের খরচ চালানোর সামর্থ্য নেই। করোনাকালীন প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে অনলাইন ক্লাস শেয়ার করার মতো পরিস্থিতি নেই। তাছাড়া এ দুর্দিনে অনেক পরিবার সাংসারিক খরচ যোগাতেই শিমশিম খাচ্ছে, তার ওপর অনলাইন ক্লাসের বাড়তি উপকরণ তাদের জন্য কঠিন।

করোনা প্রাদুর্ভাব শুরুর দিকে সরকারের উদ্যোগে সংসদ টিভির মাধ্যমে ‘আমার ঘরে আমার স্কুল’ নামে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের অনলাইন ক্লাস নেওয়া শুরু হয়। প্রথমে এটাই ছিল ছাত্রছাত্রীদের মাঝে ক্লাসের একমাত্র মাধ্যম। গ্রামের দরিদ্র শিক্ষার্থীদের কাছে বিনামূল্যে সংসদ টিভির অনলাইন ক্লাস আশার আলো হয়ে ওঠে। 

অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাসের নামে ভিডিও করে কিছু লেকচার ফেসবুকে আপলোড দিচ্ছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু প্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকেই অনলাইন ক্লাস চালু করেছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য যতটা না শিক্ষা কার্যক্রম তার চেয়ে বেশি অর্থ সংক্রান্ত। অনেকটা ব্যবসার মতো। তবে কিন্ডারগার্টেন বা ব্যক্তি মালিকানায় অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে তাদের শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতন এবং বিদ্যালয় ভবনের ভাড়া সম্পূর্ণরূপে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল। ইদানীং আর্থিক সংকটে অনেকে বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে এবং অভিভাবকরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।

আমাদের দেশের বহু শিক্ষার্থী দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের। যারা ইতোমধ্যে অনেক আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী টিউশনি বা পার্টটাইম চাকরির মাধ্যমে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাত, তাদের টিউশনি ও পার্টটাইম চাকরি বন্ধ হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। যেসব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন, ল্যাপটপ কেনার আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই, শুধু সেসব শিক্ষার্থীর নির্ভুল তালিকা পাঠাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনুরোধ করেছে ইউজিসি। সরকারের যুগান্তকারী এ উদ্যোগে উপকৃত হবে দেশের দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা।

বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ফলেই করোনাকালীন পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ ৭২ হাজার। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৫ লাখ এবং দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩ কোটিরও বেশি। ইন্টারনেট পরিসেবা সহজলভ্যতার কারণেই দেশের ১৪ লাখ শিক্ষার্থীর অনলাইনে পাঠদানের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে।

আশার কথা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সাধ্যমতো অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। ৫০৩টি মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্লাসরুম তৈরি করা হয়েছে এবং সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দুটি করে ল্যাপটপ ও মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরসহ ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানের কাজ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে দ্রুতই আইসিটি ল্যাব স্থাপন করা হবে।

যেহেতু বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ, তাই অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম ভালো প্রয়াস। শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের নিয়মিত চর্চা অব্যাহত রেখে অনলাইন ক্লাস চালু রাখতে হবে। শিক্ষার্থীরা দিনের অধিকাংশ সময় অনলাইনে থাকলে তাদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাদের লেখার স্বাভাবিক প্রবণতা ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এখানে অভিভাবকদের বড় ভূমিকা থাকতে হবে। তবে ভালো দিক হলো, তারা অল্প বয়সেই প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখছে। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে ভালো শিক্ষণীয় বিষয় পেতে পারে শিক্ষার্থীরা, যা শ্রেণি পাঠদানের মাধ্যমে সম্ভব নয়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের নিজের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের পাশাপাশি অন্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের পাঠদানও গ্রহণ করতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ভাণ্ডার আরও বিকশিত হওয়ার সুযোগ থাকবে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০