Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:07 pm

করোনাকালীন শিশুর মানসিক যত্ন

চন্দ্রশিলা ছন্দা: বর্তমান সময়টা পৃথিবীর সবচেয়ে সংকটময় সময়। অদৃশ্য এক ভাইরাস গৃহবন্দি করেছে ছোট-বড় সবাইকেই। ভয়াবহ এ সময়টা যেমন দীর্ঘ তেমনই অনিশ্চিত। এ সময়টাতে শুধু  শিশুরই  মানসিক অবস্থা নয়, বরং সব বয়সের মানুষই হতাশাগ্রস্ত এবং বিষন্নতায় ভুগছে। সবাই নতুন কয়েকটি শব্দের সঙ্গে নতুনভাবে পরিচিত হয়েছে। লকডাউন, কোয়ারেন্টিন, সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশনÑএ শব্দগুলো বড়দের পাশাপাশি ছোটদের মধ্যেও উদ্বেগ ও কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। অনেকেই এগুলোর অর্থ জানে না। করোনায় উদ্ভূত পরিস্থিতিটি প্রায় সবার কাছেই নতুন এবং শিশুদের কাছে তা আরও অপরিচিত ও নতুন। তাই এ ব্যাপারে তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলতে হবে। পরিস্থিতি সম্পর্কে বোঝাতে হবে। এই মুহূর্তে তাদের স্কুল বন্ধ। খেলার জন্য শিশুরা পার্ক বা মাঠে ঘুরতে যেতেও পারছে না। আত্মীয়র বাসায় বেড়ানো ও সঙ্গীদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সবই নিষিদ্ধ! এ পরিস্থিতিতে বাড়ির অন্য সদস্যদের মনোযোগ শিশুদের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন। তাদের সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাতে হবে। তাদের বয়স অনুযায়ী উপযুক্ত শব্দের মাধ্যমে পুরো ঘটনাটি কী ঘটছে এবং কীভাবে আমরা সতর্ক ও সাবধান থেকে এই রোগ থেকে রক্ষা পেতে পারি, তা বোঝাতে হবে।

শিশুরা কোমল মনের হওয়ার ফলে বিভিন্ন চাপমূলক পরিস্থিতিতে তারাও প্রভাবিত হয়। তবে তাদের ভালোলাগা-মন্দলাগার প্রকাশ হয় ভিন্নভাবে। দেখা যায়, শিশুরা মানসিক চাপ অনুভব করলে অনেক সময় খুব বেশি চুপচাপ হয়ে যায়। আবার অনেক সময় হঠাৎ করে অনেক বেশি রেগে যায়। সামান্য কারণে অভিমান বা কান্নাকাটি করতে পারে। আবার কখনো মানসিক চাপ থেকে রাতে ঘুমের মাঝে বিছানাও ভিজিয়ে ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের রেগে গেলে চলবে না; বরং তাদের সমস্যার কথা মন দিয়ে শুনতে হবে, নরম সুরে কথা বলতে হবে। অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় এ সময়টাতে বড়দের অনুভূতির প্রকাশ সহজ ও মানবিক হতে হবে। বেশি বেশি ভালোবাসায় ভুলিয়ে রাখতে হবে শিশুদের। বিভিন্নভাবে শিশুদের মনের যতœ নিতে হবে। আপনার আচরণ দিয়ে তাকে বোঝাতে হবে যে, কিছুই হয়নি। প্রয়োজনে আপনি তার পাশে আছেন এবং প্রত্যাহিক জীবনে শিশুদের যে স্বাভাবিক কাজকর্ম ও পড়ালেখা ছিল, তা চালিয়ে যেতে হবে। আজকাল ইউটিউবেও চমকপ্রদ খেলনা বানানো ও ড্রইং করার সহজ নিয়ম এ সবই পাওয়া যায়। সেসব দেখে ঘরে বসে ক্রিয়েটিভ কিছু করার জন্য উৎসাহিত করা যায় শিশুদের। এছাড়া নিজের কাজগুলো নিজে করা, পড়ার টেবিল গুছানো এবং বড়দের কাজে সাহায্য করাও শিশুদের শেখানো যায়। ছোটদের কাজের প্রশংসা করলে ছোটরা প্রচুর অনুপ্রেরণা পায়। তাই তাদের কাজের প্রশংসা করতে হবে।

বিশ্বে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস শিশুদের ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? ভারতের একজন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ জয়দেব রায় জানিয়েছেন, শিশুদের করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো খুবই কম থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রে তা বোঝা যায় না। আর তাই চিকিৎসকের কাছেও সঠিক সময়ে যাওয়া হয় না। শিশুরা যেহেতু মা-বাবা, দাদা-দাদির কাছেই বেশিরভাগ সময় থাকে, তাই তাদের  কাছথেকে শিশুদেরও সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতেই হবে। খুব ছোট বাচ্চারা বারবার আঙুল মুখে দেয়, তাদের ঘনঘন হাত ধুয়ে দিতে হবে। আবার যেসব শিশু সবে হামাগুড়ি দেওয়া শিখেছে, তাদের দিকেও মা-বাবাকে লক্ষ রাখতে হবে বিশেষভাবে। আর যেসব শিশু একটু বড়, তাদের করোনা পরিস্থিতির কারণে হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢাকা এবং যেখানে-সেখানে থুতু না ফেলার অভ্যাস করাতে হবে। কোনো কারণে যদি বাইরে যেতেই হয়, তবে মাস্ক পরার অভ্যাস করাতে হবে। শিশু যেন কোনো ব্যাপারে ঘাবড়ে না যায়, সেজন্য উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে।

বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা এখনো অতিমাত্রায় বিভক্ত। যেকোনো দেশের জন্য শিশু এবং সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে একটি জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল অনুমোদন করেছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বন্ধ থাকা ৩৪ লাখেরও বেশি শিশুর হামের দ্বিতীয় ডোজ টিকা কার্যক্রম চালু এবং করোনাভাইরাস থেকে শিশুদের রক্ষায় শিশুদের বাসায় টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা নিতে সরকারকে লিগ্যাল নোটিস পাঠানো হয়েছে। কারণ সময়মতো শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি চিন্তা না করলে লাখ লাখ শিশু স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়বে। শিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে বেড়ে উঠবে। তারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারাবে এবং মৃত্যুর ঝুঁকিতে থাকবে।

শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে ৯ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিলÑএই ১২ দিনে ৪৭ শিশু করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের করোনা-সংক্রান্ত তথ্যে দেখা যায়, ছয় মাসের শিশু থেকে ১৭ বছরের ওপরে শিশু আক্রান্ত হয়েছে। লক্ষণ নিয়ে ২০ জন , শনাক্ত হয়ে দুজনসহ মোট ২২ শিশু মারা যায়। মোট আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৪৭। এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন একটি জাতীয় দৈনিককে বলেন, আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ সিআরসি, শিশু নীতি ২০১১ এবং শিশু আইন ২০১৩-তে শিশুর স্বার্থ সবার আগে বলে উল্লেখ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শিশুর স্বার্থে আক্রান্ত শিশুর বয়সের তালিকা প্রকাশ করতে পারে। শিশুর করোনা নিয়ে যারা কাজ করছে, তাদের অভিযোগ ও পরামর্শ নিয়ে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করা যেতে পারে। তা করা উচিত। এতে অন্য শিশুরা সুরক্ষিত থাকার সুযোগ পাবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বড়দের পাশাপাশি ভিটামিন সি-জাতীয় খাবার পেয়ারা, লেবু, আমলকী, অথবা ভিটামিন সি ট্যাবলেট খেতে হবে। এর সঙ্গে সম্ভব হলে  প্রতিদিন রাতে একটি জিংক ট্যাবলেট খেলে ভালো। ভিটামিন সি এবং জিংক শরীরকে সতেজ ও সজীব রাখে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।

করোনায় আক্রান্ত হওয়ার প্রথম লক্ষণ গলাব্যথা ও শুকনো কাশি; আবার ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হলেও হাঁচি, সর্দি-সহ নাক দিয়ে পানি পড়ে। তবে করোনাভাইরাস শুরু হয় শুকনো কাশি দিয়ে। বারবার শুকনো কাশির ফলে গলার টিস্যু ফেটে যেতে পারে। তাই হালকা র’ চা বারবার খাওয়া, গরম পানি দিয়ে গড়গড় করা এবং আদা, লবঙ্গ ও গোলমরিচ পানিতে মিশিয়ে খুব ভালো করে জ্বাল দিয়ে তা বারবার খেতে হবে। সঙ্গে সামান্য মধু বা চিনি দিয়ে চায়ের সঙ্গে খেলে এবং এই পানি দিয়ে গড়গড় করলে সুস্থ থাকার সম্ভাবনা বাড়ে বলে দেখা গেছে। মনে করা হচ্ছে, এর ফলে গলায় থাকা ভাইরাসগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। পাশাপাশি গলায় গরম লাগার ফলে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ে। র’ চায়ের অ্যান্টিসেপটিক গুণও রয়েছে। চা এই ইনফেকশন রোধ করে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ড. বিজন কুমার শীল বলেন, করোনাভাইরাস শরীরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই যে আক্রমণ করে এমন নয়। সময় নিয়ে আস্তে আস্তে শরীরের মধ্যে এ ভাইরাস বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে বড়রা বাইরে থেকে বাসায় ফিরেই গরম পানি পান করা, এক কাপ হালকা রং চা খাওয়া, নাক-মুখ দিয়ে গরম পানির ভাপ নেওয়া, পানির মধ্যে এক ফোঁটা মেন্থল দিয়েও সে তাপ নেওয়া যেতে পারে। এতে নাক ভালোমতো পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে ভাইরাস ঢুকলেও শরীরের মধ্যে তা বাড়তে পারবে না। এতে শিশুসহ পরিবারের সব সদস্যই নিরাপদ থাকবে। তবে যতটা সম্ভব বাইরে না যাওয়াই এখন নিরাপদ। আর শিশুদের ক্ষেত্রে আরও বেশি যতœশীল হতে হবে। অযথা বাইরে যাওয়া এবং বেড়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে শিশুদের। বাজার কিংবা শপিংমলে নিয়ে যাওয়া তো এই করোনাকালে খুবই অন্যায়।

আসলে যত দিন করোনা প্রতিরোধের কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হচ্ছে,  তত দিন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং দূরত্ব বজায় রেখে বা সব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আর এখনই সময় সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর এবং দুপুরে ও সন্ধ্যায় শিশুদের নিয়মিত গড়গড় করার অভ্যাস গড়ে তোলা। এতে তাদের শুধু করোনাভাইরাসই নয়, দাঁত ও মুখের যত্নে এবং আরও অনেক ইনফেকশনও প্রতিরোধ করা সহজ হবে। সেজন্য অন্য সব কাজের মতো গড়গড় করা আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত। কারণ সুস্থ থাকাটাই বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত। শিশুরা আমাদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ, দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ এবং আমাদের আলোকবর্তিকা। শিশুরা হোক আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। কাজেই শিশুদের ব্যাপারে পরিবার ও রাষ্ট্র সব পর্যায়েই সচেতন হতে হবে।

পিআইডি নিবন্ধ