Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 12:14 pm

করোনাকালীন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে নারী-কিশোরীরা

চিত্ত ফ্রান্সিস রিবেরূ: কভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাতসহ বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটছে। প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও কিশোরীরা। এদিকে গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ সন্তান প্রসব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে তারা। আমাদের দেশে এখনও ১২ শতাংশ নারী-কিশোরী স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয়। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা স্বাস্থ্য খাতে নানা কর্মসূচি নিলেও করোনার প্রভাবে বর্তমানে এসব কর্মকাণ্ড কিছুটা স্থবির হয়ে পড়েছে। জেলা-উপজেলা পর্যায়েও করোনাকালীন যাতায়াতসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে নারীরা স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে কন্যাশিশু ও কিশোরীরা।

গত ১১ জুলাই করোনাকালীন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পালিত হয়েছে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারও বাংলাদেশে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস, ২০২০’ উদ্যাপন করা হয়েছে। দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘মহামারি কভিড-১৯-কে প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি খুবই যৌক্তিক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) এ বছর বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়ার কারণে অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ এবং লকডাউনের কারণে নারীদের অপারিশ্রমিক কর্মপরিধি বৃদ্ধি, মাতৃস্বাস্থ্যসেবার ব্যত্যয় ঘটাসহ লিঙ্গভিত্তিক নির্যাতনের প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।

অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্ল্যানিং (এএফপি) মিডিয়া অ্যাডভোকেসির টিমলিডার পুলক রাহা জানান, করোনা মহামারিতে গ্রাম ও শহর সব জায়গার মানুষ ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তবে এই সুযোগে বিভিন্ন জায়গায় চলছে গোপনে বাল্যবিয়ের আয়োজন। করোনাকালে আর্থিক সংকটের কারণে নিন্ম মধ্যবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। করোনার প্রভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় চাপ বেড়ে যাওয়ার কারণে কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।

বিশ্বের লাখ লাখ কন্যাশিশুকে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে ফেলেছে করোনা মহামারি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, উপার্জন কমে যাওয়া, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াসহ করোনা-সম্পর্কিত নানা কারণে বাল্যবিয়ের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক কন্যাশিশু। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে বাল্যবিয়ের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

পরিসংখ্যানমতে, সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে ২০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, করোনার কারণে আরও ২০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। বাল্যবিয়ের ঝুঁকি এসব পরিবারেই বেশি।

কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি নাসিমা আক্তার জলি বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অসহায় পরিবারের অবস্থা ফেরানোও জরুরি। অসহায় পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার চেষ্টা করছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ আড়াই হাজার টাকা করে ঈদ উপহার দিয়েছেন। বাল্যবিয়ে রোধে আইন প্রয়োগের দিকেও নজর দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিয়ের হার ছিল (১৮ বছরের নিচে) ৫৯ শতাংশ, বর্তমানে যা ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। এটি সম্ভব হয়েছে সরকারের কঠোর নজরদারি, মাঠ প্রশাসনের তৎপরতা, স্কুল-কলেজের শিক্ষক, সুশীল সমাজ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা এবং সর্বোপরি নারী ও কিশোরীদের সচেতনতার ফলে। কিন্তু করোনাকালে এ সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে জনসংখ্যার ওপরও একটি চাপ সৃষ্টি হবে।

করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রেখেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘরে থাকায় এবং হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবা না পাওয়ায় এই পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে ঘরে থাকা অনেক নারী অনাকাক্সিক্ষতভাবে গর্ভধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে। চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে করোনার কারণে নিন্ম ও মধ্যম আয়ের দেশে আগামী দিনগুলোয় শিশু ও মাতৃমৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এই দেশগুলোয় পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সম্প্রতি দেশে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির এক সভায় জানানো হয়, ২০১৯ সালে মার্চে প্রসব-পূর্ব সেবা পাওয়া নারীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৫২৬ জন। আর চলতি বছরের মার্চে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৪১৫ জন। এপ্রিলে এই অবস্থা আরও খারাপ হয়। গত বছরের এপ্রিলে প্রসব-পূর্ব সেবা নেয় ৪২ হাজার ৫৭১ জন, আর চলতি বছরের এপ্রিলে সেবা পেয়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৬২ জন। প্রতিষ্ঠানিক প্রসব কমে যাওয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। প্রসব-পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা সেবা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

করোনা সংক্রমণ মহামারি পরিস্থিতিতে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনাকালীন ও করোনা-পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে এই বাজেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা ব্যবস্থা বৃদ্ধি করতে হবে।

সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদে চিকিৎসাসহ অন্যান্য মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা এবং ১৮(১) অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টির উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক ও প্রাথমিক দায়িত্ব হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয় এবং আট হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হয়। স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তৎকালীন সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন ও স্বাস্থ্যনীতি-২০০০ প্রণয়ন করে। দিন বদলের সনদ ঘোষণার মাধ্যমে আবার ২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে এবং একটানা প্রায় ১১ বছরে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা খাতে গৃহীত নানামুখী পদক্ষেপের সুফল দেশের জনগণ আজ ভোগ করছে। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাসের যেসব লক্ষ্য নিয়ে সরকার জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি-২০১১ প্রণয়ন করেছিল, যেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই অর্জিত হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে কভিডের মধ্যেও সরকার পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের আওতায় তিন হাজার ৩৬৪টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, স্যাটেলাইট ক্লিনিক এবং ১৩ হাজার ৮১৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক যথাযথ সুরক্ষাসামগ্রী ব্যবহার করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এসব কেন্দ্র থেকে বিনা মূল্যে ৩০ প্রকারের ওষুধ, মোবাইল হট লাইনের মাধ্যমে নারী প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষা সেবা ও গর্ভধারণের বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ফলে দিন দিন সেবাগ্রহীতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের স্থাপিত এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র দেশের দুর্গম এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোসহ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে। দেশে শিশুর টিকা কাভারেজের হার শতভাগ। এটিও সরকারের বিরাট সাফল্য। বিশেষজ্ঞদের ধারণা টিকা গ্রহণের ফলে দেশে করোনা-আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুহার বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কম।

সরকার বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও করোনা মহামারি মোকাবিলা করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যথাসময়ে এসডিজি’র লক্ষ্যগুলো অর্জন করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ সৃষ্টি বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য। সুস্থ-সবল জাতি গঠনে পরিবার পরিকল্পনা, নারী ও কিশোরীদের প্রজনন এবং বয়ঃসন্ধিকালে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের সেবা অবকাঠামোগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ও গণমাধ্যম সচেতন ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।

পিআইডি নিবন্ধ