নিজস্ব প্রতিবেদক: ব্যাংকে রাখা আমানতে নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থাৎ কোনো ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের পুরোটাই ঋণ দিতে পারে না। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরেই এই নির্দেশনা মানছে না একাধিক ব্যাংক। বর্তমানে ১১টি ব্যাংক নির্দেশনার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ঋণ দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে এমন তথ্য।
জানা গেছে, গত জুন শেষে ১১টি ব্যাংক ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) সীমার নির্দেশনা লঙ্ঘন করে ঋণ দিয়েছে। এ তালিকায় প্রচলিত সুদভিত্তিক ও শরিয়াহ্ভিত্তিক ইসলামী ধারার পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক ও ইউনিট রয়েছে। দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই এসব ব্যাংক এ নির্দেশনা না মানলেও কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের।
ব্যাংকগুলো হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক), এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও মিডল্যান্ড ব্যাংক। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ও বেসরকারি প্রিমিয়ার ব্যাংকের ইসলামী শরিয়াহ্ভিত্তিক ইউনিটও ঋণ বিতরণের সীমা মানছে না।
জানা গেছে, প্রচলিত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এডিআর হিসাব করা হয়। অপরদিকে ইসলামী ধারার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ-আমানত অনুপাত (আইডিআর) ধরা হয়। দুই ধারার ব্যাংকের বেলায় এ অনুপাত পৃথকভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সময়ে সময়ে এ অনুপাত নির্ধারণ করে দেয়। খেলাপি ঋণের লাগাম টানতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হার বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু ব্যাংক উদ্যোক্তাদের চাপে ও করোনাকালে একাধিকবার এই হার পুনর্নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ গত এপ্রিলে এ হার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত মান অনুযায়ী, বর্তমানে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর হচ্ছে ৮৭ শতাংশ। অপরদিকে ইসলামী ধারার ব্যাংকের ক্ষেত্রে হবে ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রচলিত সুদভিত্তিক ধারার কোনো ব্যাংক ১০০ টাকা আমানত গ্রহণ করলে তার মধ্যে সর্বোচ্চ ৮৭ টাকার ঋণ বিতরণ করতে পারবে। আর ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলো ১০০ টাকা আমানতের বিপরীতে সর্বোচ্চ ৯২ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবে।
এই ঘোষণার পাশাপাশি তারল্যপ্রবাহ বৃদ্ধিতে ব্যাংকগুলোকে আরও ছাড় দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতসব ছাড়ের পরও এই ১১ ব্যাংক আগ্রাসী ব্যাংকিং করেছে। কিন্তু বিশেষ নজরদারি করেও এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চহারের খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, নাজুক ঋণ আদায় পরিস্থিতি, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও অর্থ পাচারের মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। এজন্য দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা মানছে না এসব ব্যাংক। আবার করোনাকালে এসব ব্যাংক থেকে আমানতও তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিচ্ছে।
তথ্য অনুযায়ী, এডিআরের শীর্ষে রয়েছে বেসরকারি খাতের প্রিমিয়ার ব্যাংক। গত জুন শেষ ব্যাংকটির এডিআর দাঁড়িয়েছে ১২২ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকের
দাঁড়িয়েছে ১১২ শতাংশ, অগ্রণী ব্যাংকের ইসলামি ইউনিটের ১৪৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ৯২ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
অপরদিকে এক্সিম ব্যাংকের ১০১ দশমিক ২৩ শতাংশ, পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) এডিআর ১০২ দশমিক ০৬ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৯৮ দশমিক ৭২ শতাংশ, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ৯৫ দশমিক ২৩ শতাংশ, ইউনিয়ন ব্যাংকের ৯৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, এবি ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ৭০ শতাংশ, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৯৩ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংকের ৯০ দশমিক ৮৯ শতাংশ ও ওয়ান ব্যাংকের এডিআর দাঁড়িয়েছে ৮৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
ব্যাংকাররা বলছেন, করোনার দোহাই দিয়ে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে একাধিক ছাড় নিয়েছে। বর্তমানে তারল্য সংকট নেই ব্যাংক খাতে। তারপরও ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে চলতেও আগ্রহ কম দেখাচ্ছে। এমন অভিযোগ করে আসছেন উদ্যোক্তারা। ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলো একই অভিযোগ করছে। তারপরও এসব ব্যাংকের আগ্রাসী বিনিয়োগ চলছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এসব ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের গন্তব্য যাচাই করে দেখা উচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের। তাহলে বেরিয়ে আসবে নির্ধারিত খাতে আসলেই ঋণ যাচ্ছে কি না।