নাঈমা ফেরদৌস: সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষেত্রে আদর্শ মা-বাবা হওয়া কঠিন। খুব কম বাবা-মাই সন্তানদের গুণগত সময় দেন। আজকাল আমরা এক কঠোর মহামারির মধ্য দিয়ে দিন পার করছি। আমরা গৃহবন্দি, অর্থাৎ করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ঘরে আবদ্ধ হয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যু বেড়েছে।
ছয় মাসেরও বেশি সময় ধরে আমাদের কোমলমতি শিশুরাও গৃহবন্দি। তারা পাচ্ছে না তাদের সেই প্রিয় বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, সহপাঠী ও শিক্ষকদের সান্নিধ্য। সবুজ মাঠ, বিদ্যালয় ঘন্টা ও সুমধুর জাতীয় সংগীত ছাড়া তাদের প্রতিটি দিন হয়ে উঠেছে বিরক্তিকর। তারা আগের মতো বেড়াতে যেতে পারছে না, যানবাহনে ভ্রমণ করতে পারছে না। ফলস্বরূপ পড়াশোনায় মনযোগ দিচ্ছে না, বড়দের কথা শুনছে না। স্ক্রিনে আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে । রাত জেগে কার্টুন দেখছে, অনেক বেলা অবধি ঘুমাচ্ছে। এদের নাজুক মন কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, রাগ দেখায়, খাবারে ও ঘুমে অনীহা তৈরি হয়। বড়দের মতো শিশুরাও কিন্তু বিষণœতায় ভোগে। এক্ষেত্রে যৌথ পরিবারের চেয়ে একক পরিবারের শিশুরা বেশি ভুক্তভোগী।
শিশুদের করোনার ভয় দেখিয়ে আতঙ্কিত করবেন না। তাদের শিখিয়ে দিন কীভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে নিজেরাই প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। জীবাণু হাতের স্পর্শে চোখে, মুখে ও নাকে লেগে দেহে প্রবেশ করে। তাই তাকে বারবার হাত ধোয়াসহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়গুলো শিখিয়ে দিন। যথাযতভাবে মাস্ক পরতে ও খুলতে শেখান। বাইরে থেকে কেউ এলে সে পরিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত তার কাছ থেকে কেন ও কীভাবে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, তাকে তা বুঝিয়ে দিন। বারবার করোনার আপডেট নিউজ শুনিয়ে তাকে ভয় পাওয়ানো থেকে বিরত থাকুন।
শিশুদের ও বড়দের মন-মানসিকতা এক নয়। তাদের ঘরে আবদ্ধ থাকতে আপনার আমার চেয়ে বেশি কষ্ট হয়। একই কাজের পুনরাবৃত্তি তারা ভালোবাসে না, বোরিং হয়। তারা আদরপ্রিয়, মাথায় হাত বুলালে শান্ত হয়, কাছে টেনে নিলে রাগ ভুলে যায়। তবে যখন যা চাইবে তা-ই তাকে দেওয়া থেকে বিরত থাকুন, বুঝিয়ে নিয়ন্ত্রণ করুন।
লকডাউন অবস্থায় আগের চেয়ে তাকে কিছু বেশি সময় মোবাইল বা টিভি দেখতে দিতে পারেন। তাদের জন্য ক্ষতিকর অথচ প্রিয় এমন কিছু সরিয়ে নেওয়ার সময় বলতে হবেÑ‘আমি জানি, এটা তোমার অনেক প্রিয়, কিন্তু অনেক দুঃখিত যে আমি তোমায় এটা দিতে পারছি না। লাইফস্প্রিং লিমিটেডের লিড সাইকো-সেক্সোলজিস্ট এবং সেক্সুয়াল মেডিসিন ইউনিটের প্রধান ডা. সুষমা রেজা বাংলাদেশে আদর্শ প্যারেন্টিং নিয়ে কাজ করে থাকেন। অনলাইনে ভিডিও দেখেও মা-বাবারা চাইলে এমন অনেক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে পারেন।
শিশুদের সামলানো আসলেই কঠিন কাজ। আমাদের যুগে মা-বাবারা ঘরে রাখার জন্য আমাদের বকাবকি করতেন। আর আমরা বাইরে খেলতে যায় না বলে শিশুদের বকাঝকা করি (যদিও এখন তার বিপরীত)। ঘরকুনো হয়ে সময় কাটানো কতই না কঠিন। তাই বিষণœতা দূর করতে মা-বাবা দুজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। চোখে চোখ রেখে তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। ধর্মীয় ইমান-আকিদা শিক্ষা দিন। নিজ নিজ ধর্মীয় কাজে আগ্রহী ও অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে পারেন। প্রয়োজনে তার খেলার সঙ্গী হোন। তাকে দাবা, কেরাম ও লুডু খেলতে দিতে পারেন। গল্পের বই, সাধারণ জ্ঞানের বই, কমিকস, সায়েন্স ফিকশান, মানচিত্র বিশ্লেষণসহ জানা-অজানার বই পড়তে উৎসাহিত করতে পারেন। রং-তুলি, রঙিন কাগজ, কলম, পেন্সিল, কাঁচি, গাম প্রভৃতি দিয়ে তৈরি করতে দিতে পারেন সৃজনশীল কিছু। বাগান পরিচর্যায় মনোযোগী করতে পারেন। বাড়ির নিরাপদ আঙিনায় দোলনা বানিয়ে দিতে পারেন। ছাদে বা উঠানে সাইক্লিং করতে দিতে পারেন। সেইসঙ্গে ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, রাতে দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া, দু’বেলা নিয়মিত দাঁত ব্রাশের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন। নিজের পড়ার টেবিল গোছানো, নিজের হাতে খাবার খাওয়া, বড়দের কাজে সাহায্য করা, ছোটদের স্নেহ করা, সময়ের কাজ সময়ে করা এগুলোও শেখাতে পারেন। আনন্দদায়ক কাজে নিযুক্ত থাকলে বাচ্চারা একাকিত্ব বোধ করবে না। কিছু একটা লক্ষ্যস্থির করে সেই মোতাবেক কাজ করতে দিন।
পৃথিবীর কচি শিশুরা তাদের শৈশব না হারাক।তারা মনমরা হয়ে না থাকুক। আনন্দ মরে না যাক। আসুন পারিবারিক সব কাজের ভিড়েও তাদের একটু বেশি সময় দিই, মূল্যায়ন করি, সম্মান করি; তবেই তারা আদর্শ মা-বাবার আদর্শ সন্তান হয়ে গড়ে উঠবে।
প্রভাষক, জুরানপুর আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
দাউদকান্দি, কুমিল্লা