সাত মাস বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

করোনাকালে ঘরেবাইরে সমস্যার বেড়াজালে অভিভাবক-শিক্ষার্থীরা

তৌহিদুর রহমান: রাজধানীর অদূরে নরসিংদীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র নোমান আল সাদ। করোনাকালে বন্ধ স্কুল, এ অবস্থায় বাড়িতেই কাটছে সময়। তবে পড়াশোনায় নয়, এখন তার ব্যস্ততা স্মার্টফোন নিয়ে। অবশ্য সর্বশেষ দুই মাসে অনলাইনে ও গৃহশিক্ষকের মাধ্যমে কিছুটা পড়াশোনা শুরু হয়েছে। তবে তার স্মার্টফোন আসক্তি থেকে ফেরানো যায়নি। এমনকি অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা ও টিউশনের বাইরে অন্য সময়ে তার পড়াশোনায় আগ্রহ নেই। শুধু নোমানই নয়, করোনাকালে শহর থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ ধরনের পরিস্থিতিই মোকাবিলা করতে হচ্ছে অভিভাবকদের।

শিক্ষা গবেষকরা বলছেন, করোনা মহামারির আগে যতটা সম্ভব শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন, কম্পিউটারের মতো ডিভাইস থেকে দূরে রাখার কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, তারা অনেক ক্ষেত্রে শতভাগ সময় ডিজিটাল ডিভাইসে কাটাচ্ছে। এটা প্রকৃতপক্ষে খুবই উদ্বেগের বিষয়। তাদের করোনা পরিস্থিতির পরে কীভাবে ডিভাইসে আসক্তি থেকে ফেরানো যাবে, সেটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি ও সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন, বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির শুরুর দিকে শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গত ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা একপ্রকার ঘরে বন্দি অবস্থায় সময় পার করেছে। পড়াশোনাতেও বসাতে পারেননি অভিভাবকরা। এ সময় তাদের ঘরে স্মার্টফোন, ট্যাব, কম্পিউটারে কিংবা টেলিভিশন দেখে সময় কেটেছে। পরে টেলিভিশন ও রেডিওর মধ্যে ক্লাস প্রচারের মাধ্যমে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সরকার। কিন্তু এসব ক্লাস আকর্ষণীয়, প্রাণবন্ত এবং প্রকৃত ক্লাসের মতো না হওয়ায় আকৃষ্ট করতে পারেনি শিক্ষার্থীদের।

অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার এই সময়টাতে ছেলেমেয়েদের জোর করেও অনেক ক্ষেত্রে পড়াশোনা করানো যায়নি। স্বাস্থ্যবিধির কথা চিন্তা করে বন্ধ ছিল টিউশনি, কোচিং। ফলে ডিজিটাল মাধ্যমে বিশেষত স্মার্টফোন, কম্পিউটারে গেমস খেলে বা অনলাইনে নানা ধরনের কর্মকাণ্ডে তাদের সময় কেটেছে। এতে তাদের ডিজিটাল ডিভাইসে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়েছে। এখন কিছুটা পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হলেও তাদের পড়াশোনায় ফেরানো কঠিন হয়ে গেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুললে তাদের স্বাভাবিক পড়াশোনায় ফেরানো সম্ভব নয় বলে মনে করছেন অভিভাবকরা।

শুধু তা-ই নয়, অনেক শিক্ষার্থীর মনোজগতেও পরিবর্তন এসেছে। তাদের আচরণেও যথেষ্ট পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অনেক অভিভাবক। যশোর-ঝিনাইদহ অঞ্চলের একাধিক অভিভাবক জানিয়েছেন, করোনার শুরুর দিকে তারা সন্তানদের মোটেও পড়ার টেবিলে বসাতে পারেননি। এখন কিছুটা পড়াশোনা শুরু হলেও তাদের টেবিলে ফেরানো কঠিন হয়ে গেছে। অনেক সময় তাদের খারাপ আচরণ করতে দেখা যাচ্ছে বলে অভিভাবকরা জানিয়েছেন। এমনকি পড়াশোনার বাইরের নানা ধরনের কাজে গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকছে তারা।

রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্রের বাবা জহির ইলিয়াস খান বলেন, ‘করোনার শুরুর দিকে ছেলের পুরো সময় কেটেছে ইউটিউব আর অনলাইনে। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকত সে। তখন তাকে পড়ার টেবিলেই বসানো যায়নি। এখন টিউশন শিক্ষকের মাধ্যমে কিছুটা পড়াশোনা করছে। তবে অন্য সময় তার মোবাইল, টেলিভিশনেই বেশি কাটছে। চেষ্টা করেও পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলা যাচ্ছে না।’

কয়েকজন অভিভাবক জানিয়েছেন, করোনাকালে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাড়ির বাইরে আড্ডাবাজিতে বেশি সময় কাটছে তাদের। এমনকি কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে পড়ে নানা ধরনের অপকর্ম করার খবরও মিলছে। অবশ্য সম্প্রতি সরকার মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় তারা কিছুটা স্কুলগামী এবং পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘করোনার সময়ে মাধ্যমিকের বিশেষ করে নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের আচরণে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন মোড়ে তাদের দলবদ্ধভাবে আড্ডাবাজি আর মোবাইলে সময় কাটাতে দেখা যাচ্ছে। এমনকি তাদের নানা ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করতেও দেখা যায়। এগুলো মোটেও ভালো খবর নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে তাদের।’

এ বিষয়ে অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘করোনাকালে আমাদের সন্তানদের ক্ষতি হচ্ছে সত্য, তবে তারা বেঁচে থাকলে পড়াশোনা অনেক করতে পারবে। আমরা চাই, করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত কিংবা মহামারি নিয়ন্ত্রণে আসা পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাক। আগে ছেলেমেয়েদের স্মার্টফোন ব্যবহার থেকে বিরত রাখতে সবকিছু করা হয়েছে। কিন্তু এখন অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের কথা চিন্তা করতে এসব ডিভাইস তাদের ব্যবহার করাটা আবশ্যক হয়ে গেছে। এটা মেনে নিতে হবে।’

অবশ্য প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসে আসক্তি থেকে মুক্তি দেওয়া এবং পড়াশোনায় আগ্রহী করতে শুরু থেকেই কাজ করছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। দেশের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠানটি সূত্রে জানা গেছে, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এ পর্যন্ত চারটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা যায়নি। এছাড়া টেলিভিশন ও রেডিওতে ক্লাস প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য যে উদ্দেশ্যে এ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তা সফল হয়নি বলে মনে করছেন অনেকে।

নেপের একজন গবেষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনাকালে শিক্ষার্থীদের বড় ক্ষতি হয়েছে সন্দেহ নেই। তাদের পড়াশোনায় ফের মনোযোগী করাটাও কঠিন। তবে ক্লাস শুরু হলে এ ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে আমরা এখন কাজ করছি। এটা আমাদের জন্য একেবারেই নতুন একটি অভিজ্ঞতা। আগামী বছরের শুরুতে তাদের কীভাবে সহযোগিতা করা যায়, পিছিয়ে পড়া জায়গাগুলো পূরণ করা যায়, সে বিষয়ে পরিকল্পনা ঠিক করা হচ্ছে।’ এছাড়া তাদের মানসিক অবস্থা স্বাভাবিক করতেও কাজ চলছে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাহ শামীম আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনার সময়ে শিক্ষার্থীদের এভাবে ডিভাইসে আসক্তি হয়ে পড়া সত্যিই উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা আগে যেখানে শিক্ষার্থীদের পুরোপুরি স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে বলতাম, এখন সেখানে তাদের অনেক সময় কাটছে স্মার্টফোনে।’

তিনি বলেন, ‘এটা থেকে বেরিয়ে আসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এখন শিক্ষার্থীদের ক্লাস ছাড়াও অন্যান্য কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে। অভিভাবকদেরও বেশি সতর্ক হতে হবে, বিশেষ করে স্মার্টফোন থেকে বিরত রাখতে হবে। এছাড়া দেশে একটি নিজস্ব প্ল্যান করতে হবে। স্কুলগুলোকেও পরিকল্পিতভাবে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ফেরাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন।’

করোনাকালে শিক্ষার্থীদের এভাবে স্মার্টফোনে আসক্তি হওয়া থেকে ফেরাতে এবং শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর বিষয়ে কী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছেÑজানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মোহাম্মদ গোলাম ফারুক শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের যাতে মানসিকভাবে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয় সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এজন্য তাদের কাউন্সিলিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সামনের মাস থেকেই এ প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।’

এদিকে করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে আগামী বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের দাবি তুলেছেন পরীক্ষার্থীরা। তারা এ দাবির পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলছেন, ক্লাস না হওয়ায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতির সুযোগ পাননি তারা। করোনা মহামারির কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হওয়ায় তারাও এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে ইতোমধ্যে আন্দোলনও করেছেন।

যদিও পরীক্ষার এখনও অনেক সময় বাকি থাকায় এ ধরনের দাবি তোলা অযৌক্তিক বলে মনে করছেন অনেকে। দেরিতে হলেও ক্লাস শুরু করে তাদের পরীক্ষা নেওয়ার পক্ষেই জোরালো মত রয়েছে। এছাড়া এ ধরনের দাবি তোলা তাদের পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার মানসিকতা বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০