নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনাকালে যেসব ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদের পুনর্বহালের জন্য গত সেপ্টেম্বরে নির্দেশ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। দেড় মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেনি বেশিরভাগ ব্যাংক। দু-একটি ব্যাংক শুরু করলেও গতি নেই পুনর্বহাল কার্যক্রমে। এতে দিন দিন হতাশার পাল্লা ভারী হচ্ছে অনিচ্ছায় পদত্যাগকৃত ব্যাংকারদের। খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী চাকরি হারানো এসব কর্মকর্তাকে দ্রুত পুনর্বহাল করা উচিত।
চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করে, প্রমাণিত কোনো অভিযোগ ছাড়া এখন থেকে ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। করোনার এ সময়ে শুধু লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থ বা অদক্ষতার কারণ দেখিয়েও কাউকে ছাঁটাই করা যাবে না। আর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পরও করোনার এ সময়ে যাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, আবেদন সাপেক্ষে তাদের পুনর্বহাল করতে হবে।
প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়, করোনার এ সংকটময় পরিস্থিতিতে ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করা হলে কর্মীদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি হবে। একই সঙ্গে মনোবল ও কর্মস্পৃহা কমবে। ভবিষ্যতে মেধাবী ও অভিজ্ঞরা ব্যাংকে যোগদানে অনীহা দেখাবে, দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংক খাতের জন্য যা ক্ষতিকর হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ রকম প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এবং কর্মস্পৃহা অটুট রাখার স্বার্থে এসব নির্দেশনা দেয়া হলো।
এরপর ভুক্তভোগীরা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে আবেদন করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাংক এ বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এই মুহূর্তে চাকরি পুনর্বহালের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন ছাঁটাইকৃত ব্যাংক কর্মকর্তারা। একবার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একবার চেয়ারম্যান, আবার গভর্নরের দপ্তরে চিঠি দিয়েও কোনো সুফল পাননি হাজারো ভুক্তভোগী কর্মকর্তা।
সম্প্র্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে হতাশাগ্রস্ত এসব ব্যাংকার উল্লেখ করেন, ‘দীর্ঘদিন সুখে-দুঃখে ব্যাংকের সঙ্গে ছিলাম। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় প্রধান, শাখা ব্যবস্থাপক, জোনাল হেডসহ বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করে এসেছি। বর্তমানে প্রায় সবাই চাকরিজীবনের মাঝামাঝি কিংবা শেষ প্রান্তে। সন্তানেরা বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে। অনেকের গৃহনির্মাণসহ অন্যান্য ঋণের কিস্তি চলমান রয়েছে, যা বেতন-ভাতা থেকে নির্বাহ করতে হয়। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, করোনার এ সময়ে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, অন্যায় ও অমানবিকভাবে ব্যাংকের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ এবং শাখা প্রধানসহ মধ্যম ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের টার্মিনেট করা, সার্ভিস বেনিফিটসহ আর্থিক সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করাসহ নানা ধরনের হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। করোনার এই সময়ে যখন অন্যত্র চাকরি হওয়ার/পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, তখন কেউই যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিনি বা পদত্যাগের নোটিস প্রদান করিনি, তা সহজেই বোধগম্য/অনুমেয়। এরই মধ্যে প্রত্যেক ভুক্তভোগী চাকরি পুনর্বহালের জন্য পৃথক আবেদন করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাচ্ছি না। এ অবস্থায় আমাদের আবেদন, আমাদের সসম্মানে পুনর্বহাল করা হোক।’
প্রসঙ্গত, ব্যাংকারদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি বেসরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকে কর্মী ছাঁটাই বিষয়ে বিশেষ পরিদর্শন করে। এতে উঠে আসে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর মোট তিন হাজার ৩১৩ কর্মকর্তা ‘স্বেচ্ছায়’ চাকরি ছেড়েছেন। এর মধ্যে বয়স থাকার পরও স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো হয়েছে তিন হাজার ৭০ জনকে। এছাড়া ২০১ জনকে অপসারণ, ৩০ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত ও ১২ কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হয়েছে। স্বেচ্ছায় পদত্যাগ দেখানো বেশিরভাগই জানিয়েছেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগের জন্য মৌখিকভাবে তাদের একটি সময় দেয়া হয়েছিল। ওই তারিখের মধ্যে পদত্যাগ না করলে কোনো সুবিধা দেয়া হবে না বলে ভয় দেখানো হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে তারা পদত্যাগ করেন।
চাকরিতে পুনর্বহালের বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করার পর আমরা চাকরিতে পুনর্বহালের জন্য আবেদন করেছি। তবে এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাইনি। তবে শুনলাম, কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে তিন লাইনের এক ফিরতি চিঠি পাঠিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। সেখানে লেখা আছে, ‘আপনার আবেদন ব্যাংকের কাছে পৌঁছেছে। আপনাকে পুনর্বহালের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আপনাদের জানানো হবে।’
যমুনা ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ‘এ ব্যাংকের ২০০ জনের বেশি কর্মকর্তাকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। আর যারা স্বেচ্ছায় চাকরি ছাড়েননি, তাদের ছাঁটাই করেছে ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন দেখে আমরা আস্বস্ত হয়েছিলাম। আবেদন করার পরও গত দেড় মাস পার হয়ে গেছে। তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখছি না।’
যমুনা ব্যাংকের কর্মকর্তারা আরও বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যে অবিচার করা হয়েছে, তার সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত। পাশাপাশি এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া উচিত। কারণ এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানহানিকর। আমরা করোনার মধ্যেও অনেক জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছি। কিন্তু এই মানহীন অবস্থা থেকে কেউ চাকরি দিতে রাজি হয়নি।’ এটার বিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেইন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘অন্য ব্যাংকের কথা বলতে পারব না, আমরা ৪০ কর্মকর্তাকে আবেদনের ভিত্তিতে পুনর্বহাল করেছি। যারা এখনও আবেদন করেনি তাদের তো আর পুনর্বহালের সুযোগ নেই। তাছাড়া ব্র্যাক ব্যাংক থেকে বেশিরভাগ কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়েছেন।’ এক হাজার ২০০ কর্মকর্তা চাকরি ছাড়ার যে কথা ছড়িয়েছেন, তা পুরোপুরি ঠিক নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।