করোনাকালে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও যত্নশীল হওয়া চাই

ফারহান ইশরাক: সারা পৃথিবীতে করোনাভাইরাসজনিত রোগের (কভিড-১৯) যে ভয়াবহ মৃত্যুস্রোত বইছে, দিন যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে স্রোতের তীব্রতাও ক্রমেই বাড়ছে। প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটছে, আক্রান্ত হচ্ছে আরও কয়েকগুণ। তবে এর পাশাপাশি মানুষের সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরার প্রবণতাও বাড়ছে। কয়েক সপ্তাহ ধরেই করোনা-আক্রান্তদের সুস্থতার হার আগের তুলনায় ঊর্ধ্বমুখী। জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ও রোগীদের সুস্থতার হার নিয়ে ইতিবাচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কিন্তু নিরেট সত্য হলো, কার্যকর ভ্যাকসিন আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত জীবন-মৃত্যুর মাঝে থেকেই এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষকে লড়াই করতে হবে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে মানুষের সচেতনতা যে পর্যায়ে ছিল, কিছু ক্ষেত্রে সে তুলনায় সচেতনতা বেড়েছে। আবার এর বিপরীত চিত্রও সমানভাবে দৃশ্যমান। তবে মানুষ শারীরিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য যে ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করছে, মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার্থে তার এক শতাংশও করছে বলে মনে হয় না। বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানী ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপে উঠে এসেছে, মহামারির এই সময়ে সামগ্রিকভাবে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটছে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে তা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। তাই সময় থাকতেই সবার উচিত হবে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতিও সমান যত্নশীল হওয়া।

প্রায় চার মাস ধরে লকডাউনের প্রভাবে গৃহবন্দি হয়ে রয়েছে মানুষ। এর ফলে সমাজের সঙ্গে মানুষের যে স্বাভাবিক সম্পর্ক, সেটি বিনষ্ট হচ্ছে। আবার দীর্ঘদিন ঘরে থাকার কারণে সবার মধ্যে এক ধরনের মানসিক চাপ ও শঙ্কার সৃষ্টি হচ্ছে, যেটি সবাইকে ঠেলে দিচ্ছে ক্লান্তিহীন বিষন্নতার দিকে। মূলত লম্বা সময় ধরে স্বাভাবিক জীবনযাত্রার স্থবিরতাই এর প্রধান কারণ। আর এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে রয়েছে তরুণ প্রজন্ম। এ সময়ে তরুণদের বিষন্নতার আরও বেশ কিছু জোরালো কারণ রয়েছে। প্রথমত, গত চার মাসে ইন্টারনেটে প্রচলিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহার ব্যাপকহারে বেড়েছে। সারা দিন ঘরে থাকার ফলে দিনের বেশিরভাগ সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যয় করছেন তরুণেরা। এটি চারপাশের পরিবেশ থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার মানুষের মস্তিষ্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে, যা থেকে পরে বিষণœতা ও অনিদ্রার মতো বিভিন্ন জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিষণœতার দ্বিতীয় কারণ হিসেবে সামাজিক বলয় থেকে দূরে থাকাকে চিহ্নিত করা যায়। ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে সবাইকেই আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা থেকে বিরত থাকতে হচ্ছে। ভার্চুয়ালি একে অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও মানুষের মাঝে দূরত্ব বাড়ছে, আবার নিজেদের সুরক্ষার জন্য এটি উপেক্ষা করারও উপায় নেই। এর ফলে মানুষের মাঝে এক ধরনের অবসাদের সৃষ্টি হচ্ছে। তৃতীয়ত, সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ সব ধরনের সংবাদমাধ্যমে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা নিয়মিত প্রচার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ভুঁইফোঁড় অনলাইন মিডিয়ার অসত্য সংবাদ পরিবেশনের বিকৃত সংস্কৃতি। এ ধরনের সংবাদ মানুষকে আতঙ্কিত ও ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলছে, যার ফল হিসেবে মনে দানা বাঁধছে বিষণœতার মতো মানসিক ব্যাধি। চতুর্থত, লকডাউনের ফলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। স্নাতক পর্যায়ে যারা চূড়ান্ত বর্ষে অবস্থান করছেন বা স্নাতক সম্পন্ন করেছেন, তাদের অনেকেরই পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করার কথা। কিন্তু ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। আবার দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ পেলেও অনেক শিক্ষার্থী সে দেশে যাওয়ার অনুমতি মিলবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। পাশাপাশি কর্মজীবীদেরও অনেকে চাকরি হারানোর ভয় করছেন। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে করোনা-পরবর্তী সময়ে চাকরির বাজারে যে অস্থিতিশীলতার পূর্বাভাস দেওয়া হচ্ছে, সেটিও সবাইকে ভাবিয়ে তুলছে। এর ফলে শিক্ষার্থী, সদ্য পাস করা গ্র্যাজুয়েট ও কর্মজীবীসহ তরুণ সমাজের

একটি বিশাল অংশ দুশ্চিন্তা ও শঙ্কার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এটিও এই সময়ে তরুণ প্রজন্মের বিষন্নতার অন্যতম প্রধান একটি কারণ।

আপাতদৃষ্টিতে এই দৃশ্যগুলো স্বাভাবিক মনে হলেও দীর্ঘ সময় ব্যবধানে নেতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য এ কারণগুলোই দায়ী। সার্বক্ষণিক বিষন্নতা অনেক সময়ই মানুষকে আত্মঘাতী করে তোলে। এর ফলে সমাজে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। অপরাধবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের সহিংস আচরণের পেছনেও বিষণœতার প্রচ্ছন্ন প্রভাব রয়েছে, যার ফলে সমাজের একটি অংশের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। এছাড়া এ সময়ে ভুল ধারণা, দুশ্চিন্তা ও আতঙ্কের কারণে মানুষ করোনা-আক্রান্ত রোগী ও তাদের পরিবারের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে, যার প্রভাবে সমাজে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। এটি সমগ্র সমাজের মানসিক সমস্যারই রূপান্তরিত ফসল।

মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির এ রকম অসংখ্য নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে, যা ক্ষতি করছে পরিবার, সমাজ, দেশ ও সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থার। এ কারণেই মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি সবার যতœবান হতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষায় নিজেকে ও আশেপাশের মানুষকে সচেতন করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে। প্রয়োজনে কয়েক দিনের জন্য সব ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেও এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। এতে করে নিজেকে সময় দেওয়ার মাধ্যমে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে তা সমাধানের চেষ্টা করা যেতে পারে। পাশাপাশি নেতিবাচক ও ভূয়া সংবাদ পরিহার করতে হবে। ফেসবুক বা অন্যান্য মাধ্যমগুলোতে যারা এ ধরনের সংবাদ প্রচার করে, তাদের ‘আনফলো’ করে এড়ানো যেতে পারে। কর্মহীন অবসর কাটানোর ফলে বিষণœতা বৃদ্ধি পায়। তাই তরুণদের উচিত হবে এই সময়টা আত্মোন্নয়নে ব্যয় করা, নিজেকে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা।

করোনা-পরবর্তী পৃথিবীর জন্য আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে, যার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে এখন থেকেই। মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনে মনোবিদের শরণাপন্ন হতে হবে। সবাই যদি নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হয়, তবে এ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে একটি সুন্দর আগামীর প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ishrakf1971@gmail.com

বিষয় ➧

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
 
১০১১১২
১৩১৪১৫১৬১৭১৮১৯
২০২১২২২৩২৪২৫২৬
২৭২৮২৯৩০৩১