Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 2:05 am

করোনায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াবে ৩.৮%

ইসমাইল আলী: বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা (কভিড-১৯) মহামারিতে সব দেশই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এ চিত্র ভিন্ন নয়। মহামারির প্রকোপ কমাতে ২৬ মার্চ থেকে ৬৬ দিন দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ছিল। করোনার প্রকোপ না কমায় ছুটি প্রত্যাহার করা হলেও অর্থনৈতিক কার্যক্রম সীমিত আকারে চালু রাখার অনুমতি দিয়েছে সরকার।

যদিও করোনার প্রভাবে দেশের অর্থনীতি এরই মধ্যে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এতে চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অনেকটাই কমে যাবে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে বড় ধরনের ধস নামবে। ফলে রপ্তানি খাতে বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। গতকাল এক প্রতিবেদনে এমনই পূর্বাভাস দিয়েছে সংস্থাটি।

আইএমএফ বলছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে আসবে। যদিও করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে চলতি অর্থবছরের জন্য ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিল সংস্থাটি। অর্থাৎ করোনার কারণে প্রবৃদ্ধি কমে যাবে ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।

এদিকে করোনার প্রকোপ স্তিমিত হলে ২০২১ সালে প্রবৃদ্ধির চাকা আবার কিছুটা সচল হবে। এতে আগামী (২০২০-২১) অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আর করোনা না থাকলে আগামী অর্থবছর স্বাভাবিকভাবে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করে আইএমএফ। যদিও ২০২১-২২ অর্থবছর আবার বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক চেহারায় ফিরবে বলেও সংস্থাটি মনে করছে। এতে সে অর্থবছর বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

প্রসঙ্গত, কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলারের জরুরি সহায়তা দেবে আইএমএফ। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাবে এই সহায়তার পরিমাণ ৬ হাজার ২২২ কোটি টাকা। গত ২৯ মে সংস্থাটির বোর্ডে এ প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এর আগে বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আইএমএফ। তা গত ২১ মে সম্পন্ন হয়। গতকাল এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়।

এদিকে বড় দাতা সংস্থাগুলোও বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে। আর দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট মনে করে, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসতে পারে।

যদিও গত (২০১৮-১৯) অর্থবছর ৮ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় বাংলাদেশের। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, চলতি অর্থবছরেও প্রবৃদ্ধি কোনোভাবেই ৬ শতাংশের কম হবে না।

আইএমএফ বলছে, করোনা মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাচ্ছে। এ কারণে করোনার ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে আইসোলেশন-লকডাউন করতে হচ্ছে, যা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যদি চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধে এই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আনা যায় ও অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক হয়, তবে আগামী অর্থবছর প্রবৃদ্ধি বাড়বে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি আমদানি ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পূর্বাভাসও দিয়েছে আইএমএফ। সংস্থাটি বলছে, চলতি অর্থবছর বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। আর আমদানি খাতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া চলতি হিসাবে ঘাটতি দাঁড়াবে জিডিপির ২ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও এ হিসাবে প্রায়ই ঘাটতি থাকে বাংলাদেশের। তবে এ অর্থবছর ঘাটতি অনেকটা বাড়বে। আর সার্বিকভাবে ঘাটতি দাঁড়াবে জিডিপির ৬ দশমিক ৩ শতাংশ।

যদিও আগামী অর্থবছর আমদানি-রপ্তানি চিত্র কিছুটা ইতিবাচক বলে মনে করছে আইএমএফ। এক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি খাতে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে। তবে আমদানি প্রবৃদ্ধি দাঁড়াবে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। আর চলতি হিসাবে ঘাটতি আরও বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া সার্বিক ঘাটতি দাঁড়াবে জিডিপির ৬ দশমিক ১ শতাংশ। তবে করোনা আঘাত না হানলে চলতি ও আগামী অর্থবছর আমদানি ও রপ্তানি খাতে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকত বলে মনে করছে আইএমএফ।

করোনার কারণে রেমিট্যান্সেও বাংলাদেশের জন্য সুখবর নেই। ফলে রিজার্ভে পতন ঘটবে বলে জানাচ্ছে আইএমএফ। সংস্থাটির হিসাবে চলতি অর্থবছর রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ। করোনা না থাকলে যা ১৮ শতাংশে পৌঁছাত। আর আগামী অর্থবছর রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ব্যাপকভাবে কমে যাবে। সে সময় ৭ দশমিক ১ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হবে এ খাতে।

এদিকে অর্থবছর শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩ হাজার ৬৫ কোটি ডলার, গত অর্থবছর শেষে যা ছিল ৩ হাজার ২৭৬ কোটি ডলার। আর আগামী অর্থবছর শেষে রিজার্ভ আরও কমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৬৭৮ কোটি ডলার। যদিও করোনা আঘাত না হানলে এক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা থাকত বলেই মনে করছে সংস্থাটি।

যদিও করোনার কারণে দেশের মূল্যস্ফীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছে আইএমএফ। সংস্থাটির পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছর মূল্যস্ফীতি দাঁড়াবে ৫ দশমিক ৭ শতাংশ। আগামী বছর তা থাকবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনা আঘাত না হানলেও মূল্যস্ফীতি একই থাকত বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি।

এদিকে করোনার কারণে ব্যক্তি খাতে সঞ্চয় প্রবণতা কমে যাবে। এছাড়া সরকারের রাজস্ব আদায় পরিস্থিতিতেও ধস নামবে। সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও অনেক কমে যাবে। বেসরকারি খাতের পাশাপাশি সরকারি খাতেও বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। সার্বিকভাবে অর্থনীতি বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

আইএমএফ বলছে, কভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে যেমন অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে গেছে, অন্যদিকে রপ্তানিও তলানিতে নেমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে লেনদেন ভারসাম্য ও রাজস্ব চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশকে ৭৩ কোটি ২০ লাখ ডলার জরুরি সহায়তা দিচ্ছে সংস্থাটি।

দ্য র‌্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (আরসিএফ) অ্যান্ড পারচেজ আন্ডার দ্য র‌্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্র–মেন্টের (আরএফআই) আওতায় এই ঋণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। র‌্যাপিড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটির আওতায় দেওয়া হচ্ছে ২৪ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এই ঋণের জন্য কোনো সুদ দিতে হয় না, সাড়ে ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। বাকি ৪৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার দেওয়া হচ্ছে র‌্যাপিড ফাইন্যান্সিং ইনস্ট্র–মেন্টের আওতায়, এই অর্থ সোয়া তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আইএমএফ। প্রয়োজন হলে তারা বাংলাদেশকে আরও সহায়তা দেবে। এছাড়া জরুরি সহায়তার অর্থ যাতে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়, তার জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।’

আইএমএফ বলছে, কভিড-১৯-এর প্রভাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি খাত তৈরি পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাদেশ একদিকে রোগের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে তার প্রভাবে অর্থনীতিতে শ্লথগতি দেখা যাচ্ছে। এতে রাজস্ব ঘাটতি বাড়ছে। ব্যালান্স অব পেমেন্টের ক্ষেত্রেও ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এই জরুরি সহায়তা বাংলাদেশকে অর্থায়নের ঘাটতি মোকাবিলায় সহায়তা করবে। পাশাপাশি রোগের বিস্তার ঠেকাতে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে আরও সহায়তা পেতে কাজ করবে।

কভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপের প্রশংসা করে আইএমএফ বলেছে, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক তারল্য ঘাটতি মেটাতে যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছে এবং আর্থিক খাত যাতে অর্থনীতির সহায়ক হতে পারে, সেই ব্যবস্থাও নিয়েছে। অর্থনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি হলে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও ছাড় দিতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে, এই ধাক্কা সামলাতে ধারাবাহিকভাবে মুদ্রার বিনিময় হার বাড়ানো, সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঠিক রাখা।’

সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার দরিদ্র ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য তাৎক্ষণিকভাবে যে সহায়তা প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তারও প্রশংসা করেছে আইএমএফ। ‘সামষ্টিক অর্থনীতির সম্ভাবনা অক্ষুণœ রেখে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকার সহায়তা করেছে’এসব পদক্ষেপের প্রশংসা করেছে আইএমএফ।