ইসমাইল আলী: ২০২০ সালের মার্চের শুরুর দিকে দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তবে তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া রোধে ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, যা চলে ৬৬ দিন। এরপরও করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় সীমিত পরিসরে আর্থিক ও অন্যান্য কার্যক্রম শুরু করা হয়। তবে করোনার কারণে সরাসরি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
চাকরি চলে যাওয়া, বেতন/আয় হ্রাস পাওয়া, ব্যবসা বন্ধ হওয়া, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হয় সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিবার একাধিক আর্থিক সমস্যায় পড়ে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘আর্থসামাজিক ও জনমিতিক জরিপ ২০২৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ২০২২ সালে বিবিএসের পরিচালিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’-এর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারী ৫৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ পরিবারই জানিয়েছে, করোনার কারণে তারা নানা ধরনের আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। তবে ৩৬ দশমিক ১৪ শতাংশ পরিবার জানায়, তারা কোনো ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়নি। জরিপে অংশগ্রহণকারীরা আরও জানান, করোনা অতিমারির জন্য সৃষ্ট আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে তারা নানা ধরনের কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ পরিবার একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিল।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, করোনা অতিমারির কারণে একক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে খুবই কম পরিবার। এর মধ্যে চাকরি হারিয়েছিল পাঁচ দশমিক ০১ শতাংশ পরিবার তথা খানা ও বেতন হ্রাস পেয়েছিল এক দশমিক ৫৪ শতাংশ। এছাড়া ব্যবসার ক্ষেত্রে পণ্যের বাজার হারিয়েছিলেন এক দশমিক ২১ শতাংশ, ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল দুই দশমিক ০৫ শতাংশের। ওই সময় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ পরিবারের এবং সঞ্চয় হ্রাস পেয়েছিল তিন দশমিক ০৭ শতাংশ পরিবারের।
উল্লিখিত সমস্যা ছাড়াও অন্যান্য সমস্যায় ভুগেছে এক দশমিক ৭৭ শতাংশ পরিবার তথা খানা। তবে করোনার কারণে এসব সমস্যার একাধিকটার সম্মুখীন হয়েছে ৭৩ দশমিক ৮৪ শতাংশ পরিবার। গ্রামে ও শহরে এ হার প্রায় কাছাকাছিই ছিল। তবে বেতন কমে যাওয়া, চাকরি হারানো এবং ব্যবসা বন্ধ হওয়ার প্রবণতা বেশি ছিল শহরাঞ্চলে। আর জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও সঞ্চয় হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক বেশি ছিল গ্রামাঞ্চলে।
করোনার সময় একক সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাকরি হারায় ঢাকা বিভাগের পরিবারগুলো, যার হার ছিল ছয় দশমিক ৫৭ শতাংশ। এ হার সবচেয়ে কম ছিল রাজশাহী বিভাগে তিন দশমিক ৫৭ শতাংশ। এছাড়া রংপুরে তিন দশমিক ৭০ শতাংশ, সিলেটে তিন দশমিক ৮০ শতাংশ, খুলনায় চার দশমিক ৭৫ শতাংশ, বরিশালে চার দশমিক ৭৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে চার দশমিক ৭৮ শতাংশ ও ময়মনসিংহে পাঁচ দশমিক ২৬ শতাংশ পরিবারের সদস্য করোনার চাকরি হারায়।
ওই সময় বেতন হ্রাসের ক্ষেত্রে শীর্ষে ছিল ঢাকা বিভাগের জেলাগুলো। ঢাকায় তিন দশমিক ০৬ শতাংশ পরিবার বেতন হ্রাসের সম্মুখীন হয়। অথচ চট্টগ্রামে এ হার ছিল অর্ধেকের কাছাকাছি তথা এক দশমিক ৮৭ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে তা ছিল এক দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে অন্যান্য বিভাগে এ হার এক শতাংশ, কোথাও বা আধা শতাংশেরও কম। এর মধ্যে সবচেয়ে কম রংপুর বিভাগে, যার পরিমাণ শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ।
এদিকে করোনার সময় পণ্যের বাজার হারানোয় শীর্ষে ছিল রাজশাহী, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও খুলনা বিভাগ। ওই সময় সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রাম ও রংপুর। আর ঢাকা ও সিলেট বিভাগ পণ্যের বাজার হারানোয় মাঝারি মানের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে ব্যবসা বন্ধ হওয়ার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঢাকা বিভাগের খানাগুলো, যার হার ছিল তিন দশমিক ১৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলেট বিভাগের পরিবারগুলো, যার হার ছিল শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ।
বিবিএসের জরিপে উঠে এসেছে, করোনার সময় জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির শীর্ষে ছিল বরিশাল বিভাগ। এ বিভাগের ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রার ব্যয় ওই সময় বৃদ্ধি পেয়েছিল। এছাড়া জরিপে অংশ নেয়া ময়মনসিংহের ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, খুলনার ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ, সিলেটের ১৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ, রাজশাহীর ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ এবং রংপুরের ১১ দশমিক ৫৫ শতাংশ পরিবার জানায় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল। তবে ওই সময় ঢাকার মাত্র সাত দশমিক ২২ শতাংশ ও চট্টগ্রামের ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ পরিবার জানায় তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছিল।
একইভাবে সঞ্চয় হ্রাসের ক্ষেত্রেও সে সময় শীর্ষে ছিল বরিশাল বিভাগ। তবে সঞ্চয় হ্রাস পাওয়ার কথা সবচেয়ে কম জানিয়েছে সিলেটের পরিবারগুলো। যদিও করেনার সময় একাধিক আর্থিক সমস্যায় সবচেয়ে কম ভোগে বরিশাল বিভাগের পরিবারগুলো। ওই বিভাগে এ হার ছিল ৬৬ দশমিক ৭১ শতাংশ।
একাধিক আর্থিক সমস্যায় সবচেয়ে বেশি ভোগে রংপুর বিভাগের পরিবারগুলো, যার হার ছিল ৭৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া চট্টগ্রামের ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, সিলেটের ৭৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ঢাকার ৭৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, রাজশাহীর ৭৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, খুলনার ৭২ দশমিক ৪১ শতাংশ ও ময়মনসিংহের ৬৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ পরিবার করোনার সময় একাধিক আর্থিক সমস্যায় ভোগে।
করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে ওই সময় খানা তথা পরিবারগুলো নানা ধরনের কৌশল অবলম্বন করে বলে বিবিএস তুলে ধরেছে। এর মধ্যে একক কৌশল অনুসরণের হার ছিল খুবই কম। বেশিরভাগ পরিবারই একাধিক কৌশল অবলম্বন করে, যার হার ছিল ৮২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
একক কৌশল অবলম্বনের মাঝে সবচেয়ে বেশি ছিল সঞ্চয় বন্ধ করে দেয়া, যার হার ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। এছাড়া তিন দশমিক ১৫ শতাংশ পরিবার সে সময় নিম্নমানের বা কম পুষ্টিকর খাদ্যপণ্য ক্রয় করে ব্যয় সাশ্রয় করে। এর বাইরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যয় কিছুটা কমানো, তাজা শাকসবজি ও মাছ-মাংস কেনা কমানো, সম্পত্তি বা যানবাহন বিক্রি, গহনা বা জমি বিক্রি প্রভৃতির মাধ্যমে বাড়তি ব্যয় বা কমে যাওয়া আয় সমন্বয় করে জীবনযাপন করে অনেক পরিবার।