করোনায় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ছাদ বাগান

মো. নূরুল আবছার: করোনাভাইরাসজনিত রোগ কভিড-১৯-এর আক্রমণে সারা বিশ্ব টালমাটাল। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে সমানতালে। কভিড সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রায় প্রতিটি দেশেই করতে হয়েছিল লকডাউন। তবুও মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। এমন ভয়াল পরিস্থিতিতে এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সন্তোষজনক কোনো সমাধান নেই, এখনও ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি। তাই করোনাভাইরাস প্রতিরোধে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোই একমাত্র পথ। তাছাড়া স্বাস্থ্যবিধিও মানতে হবে যথাযথভাবে।

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা হুমকিতে পড়েছে। তাই এখনই উত্তম সময় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিজ অবস্থান থেকে কাজ করে যাওয়া। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে ছাদ বাগান বা বাড়ির আঙিনায় বাগান হতে পারে উত্তম পন্থা। লকডাউনের কারণে বেশিরভাগ মানুষই বাড়িতে অবস্থান করেছেন; ফলে কাজের চাপ ছিল না। তাই বেশিরভাগ সময়ই পরিবারের সঙ্গেই কেটেছে অধিকাংশ মানুষের। করোনাভাইরাসের কারণে বাজার থেকে তরতাজা ফলমূল, শাকসবজি ও অন্যান্য পণ্য কেনা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এ সমস্যার একমাত্র সমাধান হলো ছাদ বাগান বা বাড়ির আঙিনায় বাগান করা। প্রায় প্রত্যেক বাড়ির ছাদে প্রচুর জায়গা ফাঁকা পড়ে থাকে এই জায়গাগুলোতে মাটির টবে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফলমূল যেমনÑআম, পেয়ারা, আমলকী, জাম, জামরুল, বরই প্রভৃতিগাছ লাগানো যায়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি যেমন বেগুন, পুঁইশাক, ধুন্দল, ঝিঙে, লাউ, কুমড়া, বরবটি, টমেটো, শসা, মরিচ প্রভৃতি গাছ লাগানো যায়। অনেকেই আবার ভবনের গায়ে ঝুলন্ত বাগান করতে পছন্দ করেন, এটিও করা যায়। আবার যারা গ্রামে বাস করেন তারা গ্রামের বাড়ির আঙিনায় বা পরিত্যক্ত জায়গায় এ অবসর সময়ে বাগান বা সবজির আবাদ করতে পারেন। ছাদ বাগান বা বাড়ির আঙিনায় বাগান করা গেলে একদিকে যেমন খুব সহজেই প্রতিদিনের খাদ্যের জোগান দেওয়া সম্ভব, অন্যদিকে পুষ্টি চাহিদা মেটানোও যায়। আবার উদ্বৃত্ত অংশ বিক্রি করেও বাড়তি অর্থ উপার্জন করা যায়। ছাদ বাগানে বা বাড়ির আঙিনায় যে ফলমূল ও শাকসবজি চাষ করা হবে তা সম্পূর্ণ বিষমুক্ত ও নিরাপদ, তাই ছাদ বাগান নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতেও বিশেষ ভূমিকা রাখে।

রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে নিরাপদ ফলমূল ও শাকসবজি খাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর ছাদবাগান থেকে তোলা ফলমূল এবং শাকসবজি বিষমুক্ত, তাই এগুলো খেলে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। ফলে নিশ্চিত হবে খাদ্য নিরাপত্তা, কমবে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। বাজার করতে গেলেই জনসমাগমের মধ্যে যেতে হবে; ফলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তাছাড়া বাজার থেকে সবজি কিনে এনে তা আবার ভালো করে ধুয়ে সংরক্ষণ করা আরেক বাড়তি ঝামেলা ও সংক্রমণের ঝুঁকি থেকেই যায়। তাই খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও ছাদ বাগানের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে। ছাদ বাগান থাকলে প্রচুর অক্সিজেন উৎপন্ন করে, যা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য। ছাদ বাগান বৃষ্টির পানির যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করে বিভিন্ন ধরনের পাখির আবাসস্থল তৈরি করে, যা জীববৈচিত্র্য রক্ষায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাগান করলে মানসিক প্রশান্তি আসে। করোনাকালীন দুশ্চিন্তা থেকে আমাদের রক্ষা করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। ছাদ বাগান ভবনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে সাহায্য করে, রেডি-টু-ইট খাবারের প্রতি নির্ভরতা কমায় এবং তাজা ফলমূল ও শাকসবজির জোগান দেয়। ছাদকে বিভিন্ন দুর্যোগের হাত থেকে বঁচাায়, ফলে ছাদের জীবনকাল বৃদ্ধি পায়। ছাদ বাগান বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবহার কমায়, কারণ গাছপালা প্রাকৃতিকভাবেই পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখে, জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ করে। শহরে গাছপালার বড়ই অভাব, তাই ছাদবাগান প্রতিষ্ঠা করা গেলে সবুজ এবং টেকসই নগরায়ন করা সম্ভব। জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি ও রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাগানে কাজ করার ফলে শারীরিক ব্যায়ামও হয়ে যায়।

বর্তমান বিশ্বে শিল্পায়নের ফলে বায়ুদূষণ বেড়েছে মারাত্মক হারে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজধানীসহ বড় বড় শহরের বাতাস বেশ অস্বাস্থ্যকর। এতে ভারী ধাতু, বিভিন্ন ক্ষতিকারক রাসায়নিকের মাত্রা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য ছাদবাগান ও আঙিনায় বাগান করা খুবই জরুরি। গবেষণায় দেখা গেছে, গাছপালা বাতাসের এই দূষণের মাত্রাকে কমাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। ফলে শহরের বাড়িগুলোর ছাদে বেশি বেশি বাগান করা হলে বাতাসের মান আস্তে আস্তে উন্নত হবে। এতে নগরবাসীর নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে সহায়ক হবে।

করোনার উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছিলেন একখণ্ড জমিও যেন পতিত না থাকে। প্রতি ইঞ্চি জমি আবাদের আওতায় আনতে হবে। কারণ করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষিই হবে উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। দেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণ কমানোর একমাত্র পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপায় হচ্ছে বৃক্ষরোপণ করা। ছাদে ও বাড়ির আঙিনায় প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা গেলে বিভিন্ন ধরনের দূষণ কমানো সম্ভব হবে।

শাকসবজি রপ্তানিতেও নীরব বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে দেশে। প্রতিনিয়ত এ খাতে আয় বাড়ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে শাকসবজি রপ্তানিতে লক্ষ ধরা হয়েছিল ১৩ কোটি ডলার। ওই সময়ে আয় এসেছে ১৩ কোটি ২৮ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আয় হয়েছিল ৬ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। সে হিসাবে গত অর্থবছরে পূর্বের অর্থবছরের তুলনায় আয় হয়েছে ১০৫ শতাংশ বেশি। এসব সম্ভব হয়েছে সবজি চাষে মানুষের সচেতনতার কারণে।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর আলু, ধনিয়া পাতা, লাউ, লাউ শাক, বরবটি, কাঁকরোল, করলা, ঝিঙে, লালশাক, বেগুন, টমেটো, পটোল, কচু, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, পেঁপে, কাঁচাকলা, শসা, শিম, বাঁধাকপি, মরিচ, মুলাসহ অর্ধশতাধিক সবজি বিদেশে রপ্তানি হয়। এসব পণ্য সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, দুবাই, ইউরোপের বিভিন্ন দেশসহ ৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ছাদ বাগানে এবং বাড়ির আঙিনায় নারীদের উৎপাদিত সবজি বিদেশে রপ্তানিতে বড় ভূমিকা রাখছে।

একসময়ে দেশের কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ও অঞ্চলেই সবজির চাষাবাদ হতো। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যশোরেই শুধু সবজির চাষ করতেন কৃষকরা। বর্তমানে দেশের সব এলাকায় সারা বছরেই সবজির চাষ হচ্ছে। ১ কোটি ৬২ লাখ কৃষক পরিবার সবজি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে। সারা দেশে ৬০ ধরনের ও ২০০ জাতের সবজি উৎপাদিত হচ্ছে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

দেশে বিষমুক্ত সবজির উৎপাদন বাড়ার ফলে সবজি রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে। কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদনের ফলে ইউরোপীয় দেশগুলো এখন বাংলাদেশ থেকে সবজি আমদানিতে ঝুঁকেছে। মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের মতে, জৈব সার কাজে লাগিয়ে সবজি উৎপাদন হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো রাসায়নিক বা বিষ ব্যবহার করতে হয় না। আর এ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে এখন বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ পদ্ধতি আগামী দিনে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে সারা দেশের কৃষকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে কৃষকের খরচও কম হবে। কিছুদিন আগে ঢাকা উত্তরের মেয়র সবুজ ঢাকা গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেছেন, ছাদে বাগান করলে ১০ শতাংশ হোল্ডিং কর মওকুফ করা হবে। তিনি প্রতিটি বাড়ির ছাদে ছাদ বাগান করার আহ্বান জানিয়েছেন।

সর্বোপরি ছাদ বাগান ও বাড়ির আঙিনায় বাগান খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের অন্যতম হাতিয়ার। এটি একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মাধ্যমও বটে। সুস্থ-সবল জাতি গঠনে এ বাগানের ভূমিকা অপরিসীম। তাই আমাদের উচিত ছাদে, বাড়ির আঙিনায় বা পরিত্যক্ত স্থানে বাগান করা। তাহলে আমরা খাদ্যে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্যেরও জোগান দিতে পারব। তাতে অর্থনৈতিক নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে।

 পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০