Print Date & Time : 26 June 2025 Thursday 5:54 pm

করোনায় দেশে কর্মসংস্থান হারিয়েছে ২৮ লাখ তরুণ

ইসমাইল আলী: করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও লম্বা সময় লকডাউন থাকায় বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। চাকরি হারানোর পাশাপাশি আয়ও কমেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগোষ্ঠীর। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তবে করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে তরুণ (১৫-২৪ বছর) জনগোষ্ঠীর ওপর। বাংলাদেশের প্রায় ২৮ লাখ তরুণ এ সময় কর্মসংস্থান হারিয়েছে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) যৌথ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ ইমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে। এতে করোনায় এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৩টি দেশের তরুণদের কর্মসংস্থান হারানোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কভিড-১৯ মহামারিতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তরুণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে তরুণরা দীর্ঘ মেয়াদে এর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষতির শিকার বেশি হবে। যদিও মহামারির আগেই শ্রমবাজারে তরুণরা চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল। তবে কভিড-১৯ এ সংকটকে আরও খারাপের দিকে নিয়ে গেছে। আর লকডাউন এ প্রভাব বহুমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে, যা দীর্ঘ মেয়াদেও বহাল থাকছে।

লকডাউন ও স্বাভাবিক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকায় কভিডকালে মানুষের চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। এতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাধ্যতামূলকভাবে বন্ধ রাখা হয়। এতে কর্মসংস্থান পরিস্থিতির ওপর গুরুতর প্রভাব পড়েছে। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ২২ কোটি তরুণের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রা ঝুঁকিতে পড়েছে, যাদের বড় অংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।

তথ্যমতে, করোনা ও লকডাউনের কারণে বাংলাদেশে স্বল্প মেয়াদে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন ১১ লাখ ১৭ হাজার তরুণ। পরবর্তীকালে আরও ১৬ হাজার ৭৫ হাজার কর্মসংস্থান হারিয়েছেন বা হারানোর প্রক্রিয়া আছেন। অর্থাৎ করোনার কারণে বেকার হয়েছেন বা এ প্রক্রিয়ায় আছেন ২৭ লাখ ৯২ হাজার তরুণ। তবে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে করোনায় সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হারিয়েছে ভারতের তরুণ জনগোষ্ঠী। দেশটির এক কোটি দুই লাখ তরুণ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন বা এ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ পাকিস্তানে করোনায় কর্মসংস্থান হারিয়েছেন ৩৭ লাখ ৬৪ হাজার তরুণ। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় এ সংখ্যা ৩১ লাখ ৪৪ হাজার, ফিলিপাইনে ১৭ লাখ ছয় হাজার, থাইল্যান্ডে ১১ লাখ ৪৮ হাজার ও ভিয়েতনামে ৯ লাখ ১৮ হাজার। এর বাইরে কম্বোডিয়ায় চার লাখ, নেপালে তিন লাখ ১১ হাজার ও শ্রীলঙ্কায় দুই লাখ ৫৩ হাজার তরুণ করোনায় তরুণ কর্মসংস্থান হারিয়েছেন বা এ প্রক্রিয়ায় আছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্কদের বেকারত্বের হার তিন শতাংশ, যেখানে তরুণদের মধ্যে এ হার ১৩ দশমিক আট শতাংশ। সে সময় ১৬ কোটির বেশি তরুণের কোনো কাজ ছিল না, যা এ অঞ্চলের মোট জনগোষ্ঠীর ২৪ শতাংশ। এছাড়া কভিড-১৯-এর আগেও তরুণদের একটি অংশ উপযুক্ত চাকরি পেতে বিভিন্ন ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।

তরুণদের কর্মসংস্থান হারানোর সাতটি খাত চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এগুলো হলÑকৃষি, খুচরা বাণিজ্য, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, অভ্যন্তরীণ পরিবহন সেবা, নির্মাণ খাত, টেক্সটাইল খাত ও অন্যান্য সেবা খাত। বাংলাদেশের তরুণরা এ সাত খাতে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন যথাক্রমে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ, ১২ দশমিক এক শতাংশ, দুই দশমিক ছয় শতাংশ, সাত দশমিক চার শতাংশ, ১২ দশমিক আট শতাংশ, ১৩ দশমিক ছয় শতাংশ ও চার দশমিক পাঁচ শতাংশ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনার কারণে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তরুণদের মধ্যে বেকারত্ব দ্রুত বাড়ছে। চলতি বছর শেষে ১৩টি দেশে এ হারে বড় ধরনের উল্লম্ফন হতে পারে। কোনো কোনো দেশে ২০১৯ সালের তুলনায় এ হার দ্বিগুণ আকার ধারণ করবে। এর মধ্যে করোনায় বাংলাদেশে তরুণদের বেকারত্বের হার দ্বিগুণেরও বেশি বাড়বে। এক্ষেত্রে ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল ১১ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৪ দশমিক আট শতাংশ।

এদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল ২৩ দশমিক তিন শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আর পাকিস্তানে ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল আট দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২১ দশমিক পাঁচ শতাংশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল ২১ দশমিক এক শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩৭ দশমিক আট শতাংশ।

এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল ১৭ শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ দশমিক পাঁচ শতাংশ। ফিলিপাইনে ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল ছয় দশমিক আট শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৯ দশমিক পাঁচ শতাংশ। আর থাইল্যান্ডে ২০১৯ সালে দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর বেকারত্বের হার ছিল চার দশমিক দুই শতাংশ। চলতি বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২২ দশমিক এক শতাংশ। এ হিসাবে করেনায় তরুণ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব বাড়বে থাইল্যান্ডে, যা পাঁচগুণের বেশি।

প্রতিবেদনে তরুণের মধ্যে এ বেকারত্ব নিয়ন্ত্রণে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণের সুপারিশ করেছে আইএলও ও এডিবি। এর মধ্যে রয়েছে সরকারিভাবে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, বেসরকারি খাতে শ্রমিক নিয়োগে ভর্তুকি প্রদানে সমন্বিত নীতি প্রণয়ন, তরুণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে কভিড-১৯-এর প্রভাব কমিয়ে আনা, দরিদ্র ও দুস্থ তরুণদের ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব হ্রাসে কার্র্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে তরুণদের কর্মসংস্থানকে অগ্রাধিকার দেওয়া গেলে ও এ জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা বাড়ানো গেলে কভিড-১৯-এর আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া এবং এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়ন সহজ হবে বলে মনে করছে আইএলও ও এডিবি।