সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: কদিন পর পয়লা বৈশাখ উৎসব। এরপর ঈদুল ফিতর। এ দুই উৎসব ঘিরে রঙিন হওয়ার কথা ছিল দেশীয় ফ্যাশন হাউস ও বুটিকস হাউসগুলো। তাদের বর্ণিল ও বাহারি পোশাক আকর্ষণ করত ক্রেতাকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিবর্ণ ও নিষ্প্রাণ ফ্যাশন হাউস, শোরুম ও বিপণিবিতানগুলো। চলমান করোনা ও লকডাউনের কারণে ছয় হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হারাতে বসেছেন দেশি ফ্যাশন উদ্যোক্তারা। এর ফলে খাতটিতে জড়িত শ্রমিক-কর্মচারীরা অনেকটা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ফ্যাশন হাউসের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজারের মতো। বর্তমানে দেশীয় ফ্যাশন হাউস বাজারের ব্যাপ্তি আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। এক দশক আগেও এটি ছিল এক হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে পয়লা বৈশাখে দুই হাজার কোটি, ঈদে চার হাজার কোটি এবং অন্যান্য উৎসব ও সময়ে দুই হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে।

সময়ের ব্যবধানে এক সময়ের ঘরোয়া বা শৌখিন আঙ্গিকে গড়ে ওঠা ছোট বুটিকের অনেক দোকানই বাজার সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে রূপ নিয়েছে প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডে। এর মধ্যে আড়ং, অঞ্জন’স, নিপুণ, কে-ক্র্যাফট, রঙ, নগরদোলা, দেশাল, চট্টগ্রামের শৈল্পিক, সাদাকালো, প্রবর্তনা, শ্রদ্ধা, বাংলার মেলা, অন্যমেলা, নিপুণ, নবরূপা, গ্রামীণ চেক, নীলাঞ্জনা, ওজি, বিবিআনা, রওশন’স, কৃষ্টি-সহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরেও বিস্তৃত করেছে নিজেদের বিক্রয়কেন্দ্র।
এমনকি ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডাসহ আরও কয়েকটি দেশে রফতানি করেছে বাংলাদেশি পোশাক। পাশাপাশি দেশের মানুষের পোশাক কেনার অভ্যাসেও বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এর পেছনে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের অনেক ত্যাগ ও পরিশ্রম। তাদেও বৈচিত্র্যময় ডিজাইন, নান্দনিকতা আর দেশীয় ভাবধারার এই পোশাকের দিকে সব বয়সী মানুষই ঝুঁকছে। এতে আগে শুধু ঈদ-পূজায় কেনাকাটা হলেও এখন ভালোবাসা দিবস, বাংলা নববর্ষ, মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ফাল্গুন-বসন্তসহ বিভিন্ন দিবস ও উৎসব-উপলক্ষকেন্দ্রিক পোশাক কেনার প্রবণতা বেড়েছে।

দেশের প্রথম দিককার নারী উদ্যোক্তা ও ডিজাইনার রওশন আরা চৌধুরী শেয়ার বিজকে বলেন, এবারের ব্যবসায় আমি শেষ। অনেক টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। এর আগে ২০১৭ সালের বন্যায় কোটি টাকার পণ্য ক্ষতি হয়েছে। এরপর বছরখানেক আগে শোরুমের কিছু স্টাফ চুরি করেছিল। সব মিলিয়ে এবার আমি শেষ। আমার দীর্ঘ ৩০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে এ রকম লোকসানের শিকার হইনি।
এবার মনে হয় ব্যবসা ছেড়ে দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশীয় পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন আর শৌখিন ক্ষুদ্র দোকান বা বুটিক হাউসে সীমিত নেই। ছোট থেকে যাত্রা শুরু করে অনেক প্রতিষ্ঠানই এখন একেকটি পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তাদের পুরো কর্মকান্ডই এখন একটি বিকাশমান শিল্প। কিন্তু এ শিল্পের জন্য সরকারের দিক থেকে নেই কোনো নীতিমালা বা দিকনির্দেশনা। এ খাতে ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক উদ্যোগ নিলে ব্র্যান্ডগুলো আরও ভালো করবে। এখন একজন নারী উদ্যোক্তাকে ব্যাংক লোন পেতে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভোগান্তি তো আছেই।
চট্টগ্রাম উইমেন চেম্বার ও কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক এবং কৃষ্টি বুটিকসের ডিজাইনার ও স্বত্বাধিকারী নূজহাত নূয়েরী কৃষ্টি বলেন, আমরা অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে পোশাকে-ফ্যাশনে দেশীয় চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছি। আমাদের মতো তরুণ উদ্যোক্তাদের দেখানো পথ ধরে ফ্যাশন জগতে শৈল্পিক বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। বহুমাত্রিক উদ্যোগের ফলে দেশের মানুষের পোশাক কেনার অভ্যাসে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে।
কিন্তু এক মাস যাবৎ আমাদের ব্যবসা শূন্য অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। অথচ এবারের পয়লা বৈশাখের জন্য অনেক বিনিয়োগ ও বাহারি ডিজাইনের পোশাক সম্ভার ছিল। এবার শোরুমেরও পরিবর্তন করেছি। চলমান করোনাভাইরাসের প্রভাব ও লকডাউনের জন্য আমরা শোরুম ও কারখানা বন্ধ রেখেছি গত ১৫ দিন ধরে। তবে শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতনসহ অন্যান্য খরচ পরিশোধ করেছি। আগামীতে কি হবে বুঝতে পারছি না! এর মধ্যে তো রমজান আসছে। এবার রমজানের প্রস্তুতি নিতে পারছি না। সবই তো বন্ধ। এভাবে চললে পুঁজি হারিয়ে শেষ হয়ে যাব।
ফ্যাশন এন্ট্রাপ্রেনিউরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও অঞ্জন’সের প্রধান নির্বাহী শাহীন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, আমাদের পয়লা বৈশাখে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এর মধ্যে আমরা শতভাগ প্রস্তুতও ছিলাম। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এক টাকাও ব্যবসা হয়নি। এছাড়া ঈদে আমাদের চার হাজার কোটি টাকা ব্যবসা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
এর মধ্যে ৫০ শতাংশ কাজ শেষ করেছি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কায় আছি। আমাদের এ খাতে প্রায় পাঁচ লাখ লোক জড়িত। এর মধ্যে কারুশিল্পী, সুচিশিল্পী ও বয়নশিল্পীদের সাধারণত বৈশাখ ও ঈদে বেতন হয়। তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে। যদিও আমরা কিছু কিছু বেতন দিয়েছি এবং দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, সরকার তো এসএমই খাতে ২০ কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। এর মধ্য থেকে যদি আমরা ৫০০ কোটি টাকা পাই, তাহলে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারব।
###