করোনায় ফার্মেসিতে মিলছে না জরুরি বিভিন্ন ওষুধ

হামিদুর রহমান: সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পুরোনো ঢাকার নাজিরা বাজারের বাসিন্দা তাওহীদুর রহমান ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে ডাক্তার তাকে কভিড-১৯ পরীক্ষার কথা বলেন। কিন্তু পরীক্ষায় নেগেটিভ আসায় স্বস্তি পান তাওহীদুর রহমান। এতে ডাক্তার তাকে এজিথ-৫০০ ও নাপা এক্সট্রা প্রেসক্রাইব করেন। কিন্তু এলাকার ১২টি ফার্মেসি ঘুরে কোথাও এজিথ-৫০০ পাননি তাওহীদুর। পরে ডাক্তারের পরামর্শে একই গ্রুপের (ভিন্ন কোম্পানির) জিম্যাক্স-৫০০ কেনেন। আর নাপা এক্সট্রা পেলেও দাম নেওয়া হয় বেশি।
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান রামপুরার বাসিন্দা মো. রহমতউল্লাহ। তিনি জানান, রেনোভা এক্স-আর আগে ১৫ টাকা পাতা (১০টি) ছিল। কিন্তু করোনার সংক্রমণ শুরুর পর থেকে প্রতি পাতা দাম নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা। আর নাপা এক্সট্রা প্রতি পাতা (১২টি) ৩০ টাকার বদলে দাম নেওয়া হচ্ছে ৩৫ টাকা। এছাড়া সাধারণ সি-ভিটের দামও বেশি নেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক দোকানে ভালো কোনো কোম্পানির সি-ভিট মিলছেও না, নতুন অখ্যাত কিছু কোম্পানির সি-ভিট ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ওষুধের দাম নিয়ে অবশ্য ভিন্ন কথা বলছেন বিভিন্ন ফার্মেসির মালিকরা। তারা বলছেন, করোনার কারণে বিভিন্ন কোম্পানি নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ দিচ্ছে না। সর্দি-জ্বরসংক্রান্ত ওষুধের অর্ডার দিয়েও সময়মতো সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছু ওষুধের দাম কোম্পানি থেকেই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর করোনার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওষুধ বিক্রি করতে হচ্ছে। এজন্য বাধ্য হয়ে কিছু ওষুধের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ায় ও বাড়তি সচেতনায় অনেকেই সর্দির ওষুধ ধরে রাখছেন। আর করোনার কারণে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় বিভিন্ন কোম্পানি ওষুধের কাঁচামাল আমদানিতে জটিলতায় পড়ছে। এতে বাজারে সংকট দেখা দিয়েছে বিভিন্ন ওষুধের। বিশেষ করে জ্বর, সর্দি ও কাশির বিভিন্ন ওষুধ পাওয়া এখন দুষ্কর। আবার কিছু ফার্মেসিতে ওষুধ মিললেও বাড়তি দাম নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের।
সরেজমিনে রাজধানীর বংশাল, নাজিরাবাজার, নয়াবাজার, নারিন্দা, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, মগবাজার, তেজতুরি বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, কোনো কোনো ফার্মেসিতে জ্বরের ওষুধ থাকলেও সর্দির (ঠাণ্ডা) ওষুধ নেই। আবার জ্বরের জন্য নাপা থাকলেও নাপা এক্সট্রা বা নাপা এক্সটেন্ড পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কিছু ফার্মেসিতে এসব ওষুধ পাওয়া গেলেও দাম নেওয়া হচ্ছে বেশি।
একই রকম চিত্র ঠাণ্ডাজনিত রোগের ক্ষেত্রে। এ ধরনের রোগের ক্ষেত্রে রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে সাধারণত যেসব ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে রিস, রুপা, ডেস্টার অল, ফিক্সজো, বিলটিন ও ইভারটল, ওরাডিন, এসিট্রিনসহ অন্য সব ওধুষের দাম বেশি নেওয়া অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে পুরোনো ঢাকার নাজিরা বাজারের নিউ পপুলার ফার্মেসির স্বত্বাধিকারী আমীর হামজা বলেন, মূলত করোনাকালে সাধারণ ভাইরাসজনিত সর্দি-জ্বরও বেড়ে গেছে। তাই সর্দি, কাশি ও জ্বরের ওষুধের চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় কিছু ওষুধ সাপ্লাই দিতে বিলম্ব হচ্ছে। এ কারণে সুযোগ বুঝে কেউ কেউ দাম বেশি রাখছে। তবে তার ফার্মেসিতে দাম বেশি রাখা হয় না বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে ওষুধ পাওয়া যায় না তা বিক্রি করি না। তবে রোগীকে জিম্মি করে ব্যবসা করার কোনো ইচ্ছা নেই। বিশেষত এ করোনাকালে মানুষের সেবা দেওয়াটাকে বড় বিষয় মনে করছি।’
এদিকে মগবাজার ডাক্তারস ফার্মেসির আজমির আলী বলেন, ‘আসলে ওষুধের সরবরাহ কমেনি। মূলত করোনাকালে জরুরি কিছু মেডিসিনের চাহিদা বেড়ে গেছে। চাহিদার তুলনায় কিছু মেডিসিন সরবরাহ করতে কিছুটা সময় লাগছে।’
রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে ওষুধ কিনতে আসা কয়েকজন গ্রাহকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ‘আগে এক ফার্মেসিতে সব রকম মেডিসিন পাওয়া গেলেও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। দেখা যায় জ্বরের নাপা আছে, কিন্তু নাপা ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ নেই। ঠাণ্ডা ও কাশিজনিত ওষুধের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। কিছু ফার্মেসিতে ওষুধ পাওয়া গেলে সেখানে দাম বেশি রাখা হচ্ছে। আবার কাস্টমার বুঝে একেক কাস্টমারের কাছ থেকে একেক রকমভাবে মূল্য রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে যেসব ওষুধে এমআরপি (মূল্য) লেখা থাকে না, সেগুলোয় দাম বেশি রাখা হচ্ছে।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের মতে, মানুষের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের দাম এখন দিন দিন বেড়েই চলছে। ওষুধ বিক্রেতাদের আচরণ দেখলে মনে হয় তাদের ওপর নিয়ন্ত্রক সংস্থার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিক্রেতারা যে যার ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে ওষুধ বিক্রি করছেন।
মগবাজার এলাকার অধিবাসী মুরশালিন আহম্মেদ চাকরি করছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকে। মগবাজারের একটি ফার্মেসিতে ওষুধ নেওয়ার সময় তার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমার বাবা-মা, স্ত্রীসহ পুরো পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকি। বাসায় বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্য ১২ মাস ওষুধ কিনতে হয়। জ্বর, কাশি ও ঠাণ্ডার ওষুধ নিয়মিতই নেওয়া হয়। আগে এক পাতা (১০টি) নাপা নিতাম আট টাকা করে। এখন ১০ টাকা রাখা হচ্ছে। ঠাণ্ডার জন্য মাঝে ধ্যেই ফিক্সজো-১২০ নেওয়া হয়। এক পাতার দাম আট টাকা ছিল। এটিও এখন ১০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। আবার এক পাতা না নিয়ে ভেঙে নিলে দাম আরও বেশি পড়ে।’
রামপুরা গ্রিন ফার্মেসির আবদুল সাত্তারের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘সময়টা এমন হয়েছে যে, আগে যাদের ঠাণ্ডা-জ্বরেও ওষুধ খেত না, তারা এখন স্বাভাবিক ঠাণ্ডা-জ্বরেও নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছে, যে কারণে এসব জরুরি ওষুধের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। সময়মতো সরবরাহ না পাওয়ায় কেউ কেউ ওষুধের দাম বেশি রাখছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অপসোনিন ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ খান শেয়ার বিজকে বলেন, করোনার কারণে লকডাউনের দুই মাসে সর্দি-জ্বরের ওষুধের চাহিদা বেড়ে গেছে। তবে কিছু কোম্পানি এলসি সমস্যার কারণে সময়মতো কাঁচামাল আমদানি করতে পারেনি। কিছু কোম্পানির উৎপাদন বন্ধ ছিল। আবার পরিবহনের সমস্যা ছিল বলে অনেক কোম্পানি সময়মতো সরবরাহ করতে পারেনি। কেউ কেউ এর সুযোগ নিতে পারে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০