মো. আব্দুল আলীম: রাজধানীর শ্যামলীর একটি বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করে স্বপ্না আক্তার। করোনার আগে সে নবম শ্রেণিতে পড়ত। ২০২০ সালের মার্চ মাসে করোনার কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে তাকে তার মা গ্রাম থেকে শহরে এনে বাসাবাড়ির কাজে দেন। প্রায় দেড় বছর বাসাবাড়িতে কাজ করে জমানো টাকাতেই স্বপ্নার বিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা তার মায়ের। স্বপ্না বলে, অনেক আগেই মা আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু স্কুলের শিক্ষকদের জন্য পারেননি। এখন মা বলেছেন, আর পড়ালেখা করতে হবে না। এ বছরই আমার বিয়ে দিয়ে দেবে। পাত্র খোঁজা শুরু হয়েছে। স্বপ্নার স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার। স্বপ্নার মামাতো বোন ও বান্ধবী অনেকেরই এরই মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। করোনার প্রাদুর্ভাব কমে আসায় স্কুল-কলেজ খুলতে শুরু করেছে। ক্লাসও শুরু হয়েছে। কিন্তু স্বপ্না স্কুলে যেতে পারছে না। পরিবারের চাপে এখন বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে তাকে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চিত্র মোটামুটি একই রকম, তবে করোনার কারণে বাল্যবিয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে চরাঞ্চলে। নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি কারণে চরাঞ্চলে বাল্যবিয়ের প্রবণতা এমনিতেই বেশি। আর করোনাকালে এই হার বহু গুণ বেড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনেও এটি উঠে এসেছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাকালে বেশি বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটেছে বরগুনায়। এখানে বাল্যবিয়ে হয়েছে এক হাজার ৫১২টি; এরপর কুড়িগ্রামে এক হাজার ২৭২টি, নীলফামারীতে এক হাজার ২২২টি, লক্ষ্মীপুরে এক হাজার ৪১টি ও কুষ্টিয়ায় ৮৮৪টি। আর কুড়িগ্রামের রাজারহাট ও উলিপুর উপজেলার নাজিমখাঁ, চাকিরপাশা, ধরণীবাড়ী ও দুর্গাপুর ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের হার বেশি (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক; ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১)।
ইউনিসেফের জরিপে বাল্যবিয়ের হার দেশে বর্তমানে ৫১ শতাংশ, যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ বলেন, করোনার যেসব দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব সমাজে থেকে যাবে, তার একটি হচ্ছে বাল্যবিয়ের কারণে সৃষ্ট নানা সমস্যা, বিশেষ করে অপুষ্ট আর অসুস্থ শিশুর জন্ম। বাল্যবিয়ে বন্ধে গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মানুষকে সচেতন করতে হবে সর্বোচ্চ সমন্বিত প্রচেষ্টায়।
বর্তমানে আমাদের সমাজে যেসব সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে, তার মধ্যে বাল্যবিয়ে অন্যতম। দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আমাদের সমাজে মেয়েদের এখনও উপার্জনে অক্ষম এবং পরিবারের জন্য বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ রকম আরও অনেক কারণে মেয়েরা বাল্যবিয়ের শিকার হয়। কভিডের কারণে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কভিডের কারণে সবমিলিয়ে সবাই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন যাপন করছে। এসব কারণেও বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়ছে। কারণ যা-ই হোক না কেন, বাল্যবিয়ে কোনো সমাজের জন্য কখনোই ভালো ফল বয়ে আনে না। অল্প বয়সে যে ছেলে বা মেয়েটির বিয়ে হয়, সারাজীবন তাকে নানারকম সমস্যা মোকাবিলা করতে হয় এবং অপুষ্টির চক্র চলমান থাকে। এমন পরিস্থিতিতে দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অতিরিক্ত দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বাল্যবিয়ে রোধে সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম, সিভিল সোসাইটি, জনপ্রতিনিধি এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণে বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব।
বাল্যবিয়ে রোধে শিশু অধিকার ও উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। এই অ্যাপ ১৮ বছর বয়স হয়নি, এমন মেয়েদের বিয়ে বন্ধ করতে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। গত ছয় মাসে এই অ্যাপ দিয়ে তিন হাজার ৭৫০টি বাল্যবিয়ে রোধ করা গেছে বলে দাবি করেছে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল সংস্থাটি। সংস্থাটি বাল্যবিয়ে রোধে এরই মধ্যে এক লাখের বেশি কন্যাশিশুকে এই অ্যাপ ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। নতুন মোবাইল অ্যাপটি বিয়ে নিবন্ধনের সঙ্গে জড়িত ঘটক, কাজী, ধর্মীয় ও আইনি ব্যক্তিদের ডিজিটাল ডেটাবেজের সহায়তা দেবে। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের পরিচালক জানান, বিয়ের প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রাথমিকভাবে জড়িতদের যদি প্রথমেই তথ্য জানানোর ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে কেউই কম বয়সের বিয়েকে আইনসিদ্ধ করার জন্য নিবন্ধনের সঙ্গে যুক্ত হবেন না। এটি একটি গেম-চেঞ্জার হিসেবে কাজ করতে পারে।
বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে রোধে কাজ করছেন এমন সমাজকর্মীরা বলছেন, বাল্যবিয়ের ফলে বেশিরভাগ মেয়েই স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। তারা ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়নসহ নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। প্ল্যানের চালু করা অ্যাপটিতে অফলাইন মেসেজ করার সুবিধা রয়েছে। এর ফলে ব্যবহারকারীর একটি ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দিলেই তার ব্যাপারে খোঁজ নেয়া সম্ভব হচ্ছে, তার সংশ্লিষ্ট নথিতে ঢুকে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে। যদি সংশ্লিষ্ট নারীর বয়স ১৮ বা তার বেশি হয়, অ্যাপে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই ‘প্রসিড’ বা এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ আসবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে ‘লাল সতর্কতা’ সংকেত উঠবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে বন্ধের যে ঘোষণা দিয়েছেন, তাতে সহযোগিতামূলক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে অ্যাপটি।
বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন অনুযায়ী বিয়ের জন্য মেয়েদের ১৮ এবং পুরুষের বয়স ২১ বছর নির্ধারণ করা হলেও বাল্যবিয়েতে বাংলাদেশের অবস্থান তালিকায় থাকা শীর্ষ দেশগুলোর সঙ্গেই রয়েছে। ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭’ পাসের আগে বাল্যবিয়ে রোধে ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারেজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট, ১৯২৯’ ছিল, যাতে বলা হয়েছিল কোনো নারী ১৮ বছরের আগে এবং কোনো পুরুষ ২১ বছরের আগে যদি বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই শাস্তির সময়কাল ও অর্থদণ্ড বর্তমান সময়ের সাপেক্ষে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম ছিল। ফলে এই আইনটি অনুপযুক্তই হয়ে যায় সরকারের সঙ্গে। বর্তমান ‘বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, ২০১৭’ আরও যুগোপযোগী করা হয়। বর্তমান এ আইনে বয়সের সীমা একই রেখে, শাস্তির সময়কাল ও অর্থদণ্ডের পরিমাণ সর্বোচ্চ দুই বছর এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। পাশাপাশি শাস্তির আওতায় কারা আসবে, তার পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। যারা বিয়ে পরিচালনা করেন এবং বিয়ে রেজিস্ট্রি করেন, তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। অর্থাৎ শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক বর, কনে বা তাদের পরিবারই নয়, বাল্যবিয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই আইনভঙ্গের শাস্তি পাবে।
বাংলাদেশে সব ধরনের বিয়ের ৩০ দিনের মধ্যেই আইনগতভাবে নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় না। জš§নিবন্ধন সনদ, স্কুলের ছাড়পত্র বা জাতীয় পরিচয়পত্র বয়সের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় সন্তানকে বাল্যবিয়ে দিতে পরিবারের সদস্যরা এসবে জালিয়াতির চেষ্টা করে। নতুন এ আইনের সবচেয়ে ভালো দিক হচ্ছে, বয়স নির্ধারণকারী সনদগুলো ‘নির্দিষ্ট’ করা হয়েছে। ফলে সহজলভ্য নোটারি পাবলিক দিয়ে আর বয়সের জালিয়াতি করার সুযোগ থাকছে না। তাছাড়া বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে বিচারের জন্য মোবাইল কোর্ট যুক্ত করা হয়েছে এ আইনে।
বাল্যবিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও বাল্যবিয়ের সমস্যাটি এখনও রয়ে গেছে। করোনাকালে দেশে বাল্যবিয়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে ব্যাপকহারে, যদিও বিশ্বব্যাপী কভিডের সংক্রমণের প্রভাবে বাল্যবিয়ের হার বেড়ে গেছে বহু দেশেই। বিষয়টি উদ্বেগের। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে প্রশাসন উদ্যোগ নিচ্ছে। কিন্তু একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সোচ্চার ও সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ের কারণ হিসেবে দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা, নিরাপত্তাহীনতা প্রভৃতি বিষয় চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে, ব্যবস্থা নিতে হবে। বৈশ্বিক পরিসংখ্যানমতে, সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্যবিয়ের সংখ্যা বাড়ে। এজন্য আমাদের প্রত্যেকেরই সচেতন হতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য অভিভাবকদের ব্যাপক সচেতনতা সবচেয়ে বেশি এবং সবার আগে প্রয়োজন। এছাড়া প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে বাল্যবিয়ে রোধে পরিকল্পিত উদ্যোগ নেয়া এখন সময়ের দাবি।
তৃণমূল পর্যায়ে প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও স্কুলের শিক্ষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় করোনাকালেও অনেক বাল্যবিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়েছে। বাল্যবিয়ের খবর পাওয়ামাত্র প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বাল্যবিয়ে প্রতিহত করছে। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে হবে। আর জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, বাল্যবিয়ে নির্মূল করতে হবে ২০৪১ সালের মধ্যে। তাই বাল্যবিয়ে রোধে সরকার অত্যন্ত সচেষ্ট। নানা পদক্ষেপ গ্রহণসহ সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইনে সাজা ও জরিমানা বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, স্থানীয় প্রশাসন, ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বার, উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, এমনকি সংসদ সদস্যদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের ফলে সুফল পাওয়া যাচ্ছে এ ক্ষেত্রে। বাল্যবিয়ে রোধে প্রাথমিকভাবে মা-বাবাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে গণমাধ্যমও ভূমিকা রাখছে। বাল্যবিয়ে রোধে উপজেলাগুলোয় যেসব কমিটি ও কিশোর-কিশোরী ক্লাব আছে, তা আরও বেশি মাত্রায় সচল করতে পারলে ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূল করে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠন করা সম্ভব হবে। সে অঙ্গীকার নিয়েই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজ করে যেতে হবে আমাদের সবার।
পিআইডি নিবন্ধন