করোনায় বেড়েছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা

নিহার রঞ্জন সরকার: করোনাভাইরাসের এ সংকটময় সময়ে অর্থ লেনদেনের অন্যতম ভরসা হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং। সাধারণ মানুষ বিশেষ প্রয়োজনে লেনদেন করছে মোবাইলে। তাৎক্ষণিকভাবে দ্রুত শহর কিংবা গ্রামে সর্বত্রই টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

দ্রুত টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ফলে গ্রাহক সংখ্যার সঙ্গে বাড়ছে লেনদেনের পরিমাণ। এ বছরের জুন মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহকসংখ্যা দাঁড়িয়েছে আট কোটি ৮৭ লাখ ৯৭ হাজার। সেইসঙ্গে একক মাস হিসাবে জুনে লেনদেন হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৪৯৪ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১১ সালের ৩১ মার্চ বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর মধ্য দিয়ে দেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের যাত্রা শুরু হয়। এর পরপরই ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে বিকাশ। বর্তমানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার বাজারের একটি বড় অংশ বিকাশের দখলে। বিকাশ ছাড়াও শিওর ক্যাশ, নগদ, ইউক্যাশ, রকেট, এমক্যাশ, মোবাইল মানি প্রভৃতি মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা পরিচালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, ‘নগদ’ বাংলাদেশ সরকারের ডাক বিভাগের আওতাধীন। 

করোনাভাইরাসের এ দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে গ্রাহকের কাছে মোবাইল ফোনে লেনদেন আরও জনপ্রিয় করতে বিশেষ ছাড় দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) লেনদেনের সর্বশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ও ওষুধ ক্রয়ে কোনো ধরনের চার্জ না কাটার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি (পি-টু-পি) লেনদেনে (যে কোনো চ্যানেলে) এ নির্দেশনা মানতে হবে। একই সঙ্গে লেনদেনসীমা ৭৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করা হয়েছে। এছাড়া দৈনিক এক হাজার টাকা ক্যাশ আউট সম্পূর্ণ চার্জবিহীন রাখতে বলা হয়েছে। আগে যেখানে দিনে দুবারে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করা যেত, এখন তা বাড়িয়ে দিনে পাঁচবার সর্বোচ্চ ৩০ হাজার টাকা ক্যাশ ইন করা যাবে এবং মাসে ২৫ বারে করা যাবে দুই লাখ টাকা। দিনে পাঁচবার সর্বোচ্চ ক্যাশ আউট করা যাবে ২৫ হাজার টাকা এবং মাসে ২০ বার দেড় লাখ টাকা ক্যাশ আউট করা যাবে। পাশাপাশি কোনো গ্রাহক তার ব্যক্তি মোবাইল হিসেবে সর্বোচ্চ তনি লাখ টাকা স্থিতি রাখতে পারবেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের (এমএফএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি এনসিসি ব্যাংক তাদের (এমএফএস) সেবা বন্ধ করেছে। ফলে বর্তমানে দেশে মোট ১৫টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সব ধরনের নির্দেশনা নগদের পাশাপাশি বিকাশ অনুসরণ করছে। দৈনিক এক হাজার টাকা ক্যাশ আউটে কোনো চার্জ কাটা হচ্ছে না। কল সেন্টারের সার্ভিস চালু আছে। এজেন্টদের নিয়মিত নগদ ও ইলেকট্রনিক মানি সরবারহ করা হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য সব ধরনের সেবা চালু রয়েছে।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ে শুধু লেনদেন নয়, যুক্ত হচ্ছে নতুন সেবাও। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির বিল, অর্থাৎ সেবামূল্য পরিশোধ, কেনাকাটার বিল পরিশোধ, বেতন-ভাতা প্রদান, বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স পাঠানোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সেবা দেওয়া হচ্ছে।

প্রান্তিক মানুষের ডিজিটাল লেনদেনে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত ও অধিকতর সেবা দিতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ চালু করেছে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’। অধিকতর নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বজায় রেখে মানুষকে আরও বেশি লেনদেনের স্বাধীনতা প্রদানের লক্ষ্যে এমন সেবা শুরু করেছে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। ‘নগদ’ সেবাটি পরিচালিত হচ্ছে ডাক বিভাগের বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত ‘বাংলাদেশ পোস্টাল অ্যাক্ট অ্যামেন্ডমেন্ট, ২০১০’-এর ৩-এর ২-এফ ধারা অনুযায়ী। ২০১০ সালে শুরু হওয়া বাংলাদেশ ডাক বিভাগের পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিস ছিল দেশের প্রথম ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন সামনে রেখে যাত্রা শুরু হয়েছিল ডাক বিভাগের সেবাটি।

২০১৯ সালের ২৬ মার্চে ডাক বিভাগ ডিজিটাল আর্থিক লেনদেনের সেবা হিসেবে ‘নগদ’ অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। ডাক বিভাগের দেশব্যাপী অবকাঠামো এবং আর্থিক সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে শত বছরের অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে মূল অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দেশব্যাপী ৯ হাজার ৮৮৬টি পোস্ট অফিস ও দক্ষ কর্মীদের তত্ত্বাবধানে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল খাতে ‘নগদ’ সেবা দেওয়া হচ্ছে।

ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘরে বসে মানুষ প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে। ‘নগদ’ অ্যাপ ডাউনলোড করে যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। এ অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে ঘরে বসেই সব ধরনের ইউটিলিটি বিল পরিশোধ করা যায়, টাকা পাঠানো যায় এজন্য গ্রাহককে কোনো ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে যেতে হয় না। বিদেশ থেকে প্রবাসীরা সহজেই এ চ্যানেল ব্যবহার করে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে পারেন।

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্মদিন উদ্যাপনের অংশ হিসেবে এক হাজার ৩০০ দুস্থ নারীকে ডাক বিভাগের ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা ‘নগদ’-এর মাধ্যমে দুই হাজার টাকা করে উপহার প্রদান করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট গণভবনে এক অনুষ্ঠান থেকে ৬৪ জেলার এসব দুস্থ নারীকে উপহারের অর্থ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুদানের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে পুরো খরচ বহন করে দেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সেবা ‘নগদ’। প্রত্যেক দুস্থ নারী তাদের প্রাপ্ত দুই হাজার টাকা ক্যাশ আউট করার চার্জ হিসেবে অতিরিক্ত ৩৫ টাকা করে নিজেদের ‘নগদ’ অ্যাকাউন্টে পেয়েছেন। বাড়তি এই খরচও বহন করেছে ‘নগদ’।

দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে রয়েছে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস। করোনাকালে ৫০ লাখ দুস্থ ও অসহায় পরিবারের মধ্যে আড়াই হাজার টাকা করে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিতরণ করা হয়েছে গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেতন-ভাতার টাকাও। করোনা পরিস্থিতিতে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে মানুষের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার বেড়েছে। করোনা সংকটে ব্যাংকের শাখায় ভিড় না করে অনলাইন ব্যাংকিং সুবিধা গ্রহণের জন্য গ্রাহকদের পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এমনকি কোরবানির পশু কিনতেও হাটে না গিয়ে অনলাইনে কেনার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষই চায় ইন্টারনেট সুবিধা কাজে লাগিয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মানি ট্রান্সফারসহ তাদের নিত্যদিনের কেনাকাটা ও প্রয়োজনীয় বিল পরিশোধ করতে।

মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধা নিয়ে মানুষ একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে অর্থ পাঠাতে পারছেন। এতে তারা একদিকে যেমন দ্রুত লেনদেন করতে পারছেন, অন্যদিকে সময় নষ্ট হচ্ছে না ঘরে বসেই লেনদেন করা যাচ্ছে। ভোক্তারাও লাভবান হচ্ছেন। ফলে দিন দিন মানুষের কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন ব্যাংকিং।

সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে অগ্রাধিকার দিয়ে ‘নগদ’ জনবান্ধব সব সেবা দিয়ে আসছে। অন্যান্য মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল অপারেটরগুলো খরচের ভয়ে যেখানে সুবিধাবঞ্চিত জনগণের জন্যে সেবামূলক কাজে যুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী, সেখানে ‘নগদ’ জনহিতকর এসব কাজে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। দেশের প্রতিটি প্রান্তের মানুষের কাছে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস সুবিধা দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে, যা প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০