করোনায় মায়ের স্বাস্থ্যসেবা

মুসলিমা খাতুন: ঢাকার উত্তর শাহজাহানপুর এলাকার বাসিন্দা নার্গিস কনা। বয়স ৩৪ বছর হবে। সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায়, তা নার্গিস কনার সংসারে গেলে খুঁজে পাওয়া যায়। অনেকে তার সংসার, স্বামী আর আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে ঈর্ষা করেন। গত জুন মাসে হঠাৎ নার্গিস কনা করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। অক্সিজেন লেভেল অনেক নিচে নেমে আসে নার্গিস কনার। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখেন তিনি আবারও সন্তানসম্ভবা। সংসারে দ্বিতীয় সন্তানের আগমন। সবাই আনন্দিত হয় সুসংবাদ শুনে। আবার অন্যদিকে তার করোনার সংবাদে সংসারে নেমে আসে অন্ধকার। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শে কয়েক দিন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন নার্গিস কনা।

করোনায় আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ঢাকার সব হাসপাতালেই ভর্তি করা যায়। তবে বেশি রোগী ভর্তি হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মুগদা হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা পজিটিভ মায়েদের জন্য পৃথক ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। এখানে ২০টি আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা রাখা আছে। করোনা রোগীদের সঙ্গে অন্তঃসত্ত্বা মায়েদেরও রাখা হয় সেখানে। বর্তমানে আইসিইউতে শয্যা পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এটা সরকারের নির্দেশনাও বটে।

গ্রামীণ জনপদের অসহায় দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এখান থেকে বিনা মূল্যে শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয়, প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করা হয়। ফলে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েরা সহজেই স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। কমিউনিটি ক্লিনিক হওয়ার কারণে এখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা পেয়ে যান তারা, ফলে দূর-দূরান্তে আর ছুটতে হয় না তাদের। এতে করে গর্ভবতী মায়েরা বিশেষভাবে উপকৃত হচ্ছেন। সারাদেশে এখন ১৩ হাজার ৪৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে। এসব ক্লিনিক থেকে মাসে গড়ে ৯৫ লাখ মানুষ বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নেয়। মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্যোগ বিশেষ অবদান রেখেছে। তাছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও পুষ্টিসেবা দেয়া হয়, যা অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ। এখান থেকে বিনা মূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ পায় মানুষ। গর্ভবতী মায়েরা প্রসব-পূর্ববর্তী ও প্রসব-পরবর্তী সেবাও পেয়ে থাকেন বিনা মূল্যে। এছাড়া পল্লি অঞ্চলের দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত গর্ভবতী নারীদের অসহায়ত্বের কথা বিবেচনা করে তাদের আর্থিক ও সামাজিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ২০০৭-০৮ অর্থবছর থেকে বাংলাদেশ সরকার দরিদ্র মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান কর্মসূচিও গ্রহণ করেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় করোনাকালে এই মাতৃত্বকালীন ভাতা গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এসবই সরকারের প্রশংসনীয় অবদান এবং গর্ভবতী নারীদের পাশে সরকারের থাকাকে প্রমাণ করে।

জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ নারী গর্ভধারণ করেন। গর্ভবতী মা করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীর বাড়তি কিছু জটিলতা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় ২৮ সপ্তাহের পরে করোনা হলে মায়ের মারাত্মকভাবে অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর করোনার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যাজমা, হƒদরোগ, বেশি ওজনসহ অন্যান্য জটিলতা থাকলে মায়েদের ভ্রুণের মৃত্যুও হতে পারে। করোনায় আক্রান্ত মায়েদের গর্ভস্থ ভ্রুণের মৃত্যু এবং অপরিণত বা সময়ের আগেই সন্তান প্রসবের হার দ্বিগুণ হতে পারে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, করোনায় আক্রান্ত অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জনসমাগম ও গণপরিবহন এড়িয়ে চলা উত্তম। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে ভ্রমণ না করা এবং অসুস্থ ব্যক্তির কাছাকাছি না যাওয়ার জন্য চিকিৎসকরা পরামর্শ দেন। মায়ের গর্ভে ভ্রুণ জন্ম নিলে কমপক্ষে আটবার চেকআপ করা প্রয়োজন। এর মধ্যে সন্তান জন্মের আগে চারবার সরাসরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে মাকে সেবা নিতে হয় এবং পরবর্তীকালে আরও চারবার টেলিফোনের মাধ্যমে হলেও সেবা নেয়া প্রয়োজন। সন্তান জন্মের পর স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে মেনে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো আবশ্যিক। বর্তমানে করোনা মহামারির মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকায় অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের ঝুঁকির বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের যে কোনো উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোগীকে পরীক্ষা করাতে হবে এবং করোনা বা ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনে গর্ভবতী মাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।

করোনা পরিস্থিতিতে বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষ করে সরকারি-বেসরকারি বেতার-টেলিভিশন, পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করেছে। করোনা পরিস্থিতিতে মায়েদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও চিকিৎসার বিষয়েও নানা পরামর্শ দেয়া হচ্ছে এসব মাধ্যমে। এর ফলে দেশের সর্বস্তরের মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা অনেক বেশি উপকৃত হয়েছে। তার পরও আমাদের সমাজে বসবাসরত মেয়েদের, বিশেষ করে গর্ভবতী মায়েদের গর্ভকালীন ও গর্ভপরবর্তী সময়ে উত্তম পরিচর্যার বিষয়ে আরও সচেতন করা প্রয়োজন। এর ফলে করোনা মহামারির মধ্যে এবং করোনা-পরবর্তী সময়ে গর্ভবতী মায়েদের রক্ষা করা সহজতর হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। আমাদের সচেতনতা এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন সবার আগে।

পিআইডি নিবন্ধন

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০