রহমত রহমত: দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। স্থবির শিল্পের চাকা। সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত দেশ প্রায় অবরুদ্ধ রয়েছে। এসময় অর্থনীতির সম্ভাব্য ক্ষতি হবে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আর অবরুদ্ধ পরিস্থিতি মে মাস পর্যন্ত গড়ালে ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। সম্প্রতি এক গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।
সব স্থবির থাকায় রাজস্ব আহরণ শিকে উঠার উপক্রম হয়েছে। তবে আহরণে কিছুটা আশার সঞ্চার করবে সিগারেট, ঔষধ ও সুপারশপ। কারণ অবরুদ্ধ অবস্থায় সুপারশপ থেমে নেই। সুপারশপে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বর্তমানে কয়েকগুণ বেশি বিক্রি হচ্ছে। ফলে রাজস্ব যেকোন সময়ের তুলনায় বেশি আসবে।

মহামারীর এ দুযোর্গে সবচেয়ে কাছের বন্ধু জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, যা এ অবরুদ্ধ অবস্থার বাইরে। অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে এ দুযোর্গে কয়েকগুণ বেশি ঔষধ উৎপাদন ও বিপনন হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন, বিপনন থেমে নেই সিগারেটের।
এ তিনটি খাত থেকে অবরুদ্ধের সময়ে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ রাজস্ব আহরণ হবে বলে মনে করছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্মকর্তারা। সে জন্য এ তিনটি খাতকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। করোনার সময় এ তিনটি খাতে কি পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে।
এবং এপ্রিল মাসে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় হতে পারে, তা জানতে চেয়ে এলটিইউ (মূসক) ও সব ভ্যাট কমিশনারেটে চিঠি দিয়েছে এনবিআরের ভ্যাট বিভাগ। ১৮ এপ্রিল সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মো. জামাল হোসেন সই করা চিঠি দেওয়া হয়। চিঠিতে ২৫ এপ্রিলের মধ্যে এসব তথ্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চিঠিতে বলা হয়, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতেও কিছু শিল্প ও ব্যবস্থা প্রতিষ্টান চালু রাখা হয়েছে। যেমন-সিগারেট, ঔষধ, সুপারশপ ইত্যাদি। ধরে নেওয়া যায় এসব প্রতিষ্ঠান এপ্রিল মাসেও খোলা থাকবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কি পরিমাণ রাজস্ব আসে, আসতে পারে সে বিষয়ে একটি আগাম ধারণা প্রয়োজন। বিশেষ করে চালু প্রতিষ্ঠান, যাদের লেনদেন এক লাখ টাকা বা তার উর্ধ্বে তাদের তথ্য আগামী ২৫ এপ্রিলের মধ্যে পাঠাতে হবে।
অপরদিকে, এনবিআরের রাজস্ব আহরণের সবচেয়ে বড় মাধ্যম মোবাইল ফোন অপারেটর। লকডাউনে বন্ধ নেই মোবাইল অপারেটরদের সেবা। সংক্রমণ রোধে মানুষ ঘরে রয়েছে। এসময় মানুষ অনেকটাই মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। বেড়েছে মোবাইল কলসহ সব ধরনের সেবা। ফলে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে এসবয় এ খাত থেকে সরকার রাজস্ব বেশি পাবে। সেজন্য এ খাতের দিকেও বিশেষ নজর দিচ্ছে এনবিআর। উল্লেখ, মোবাইল খাত থেকে সরকার প্রতিবছর প্রায় ২৫-২৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ করে।

অন্যদিকে, অবরুদ্ধের সময় যেকোন খাদ্যের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে সরবরাহ বেড়েছে। ফলে খাদ্য পণ্য থেকে রাজস্ব আসবে। সীমিত আকারে খোলা রয়েছে ব্যাংকিং সেবা। তবে অল্প সময় ব্যাংক হলে প্রচুর লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকিং সেবার পাশাপাশি কয়েকগুণ বেড়েছে মোবাইল ব্যাংকিং। এছাড়া ইন্টারনেট সার্ভিস, বিভিন্ন পণ্যের পরিবেশক, খাদ্য সরবরাহ, মিডিয়া, এনজিওসহ আরো বেশ কিছু খাত থেকে রাজস্ব এসময় রাজস্ব আসবে বলে মনে করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলেন, করোনার কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা খাত বন্ধ আছে, সেসব খাত থেকে রাজস্ব কমতে পারে। তাই যেসব প্রতিষ্ঠান খোলা আছে, সেখান থেকে বেশি রাজস্ব আসতে পারে। এমন বিবেচনায় সুপারশপের দিকে নজর দিয়েছে এনবিআর। সুপারশপে বেচাকেনার ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়। শুধু সুপারশপ নয়; ঔষুধ ও সিগারেটের মতো যেসব শিল্প খাত খোলা আছে, সেখানকার তথ্যও জানতে চাওয়া হয়েছে।

করোনার সময় সবকিছু বন্ধ থাকলেও নিত্যপণ্য বিক্রয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের বিভিন্ন নামিদামি সুপারশপ খোলা রয়েছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ও স্বাস্থ্যবিধি যথাসম্ভব মেনে এসব সুপারশপে বেচাকেনা চলছে। তাই মধ্যবিত্তরা কাঁচাবাজারে না গিয়ে সুপারশপমুখী হয়েছে। ফলে সুপারশপে বেচাকেনাও বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় সুপারশপের বিক্রি ২০-৩০ শতাংশ বেড়েছে।
সুপারমার্কেট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বলেন, এ সময়ে এনবিআরের এমন চিঠি সুপারশপ মালিকদের মধ্যে একধরনের চাপ তৈরি করবে। সুপারশপে বেচাকেনা কিছুটা বেড়েছে এটা যেমন সত্য, তেমনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত, কর্মীদের বাড়তি সুবিধা দেওয়াসহ নানা খরচও বেড়েছে। করোনাকালের এই বিশেষ সময়ে ঝুঁকি নিয়ে হলেও নিত্যপণ্যের জোগান দিচ্ছে সুপারশপগুলো। তাই অন্তত দুই মাসের জন্য হলেও তাদের বিদ্যমান ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা উচিত।

সুপারশপ মালিক সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালে মীনাবাজার ও আগোরার মাধ্যমে এ দেশে সুপারশপের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমান রাজধানী ও রাজধানীর বাইরে কার্যক্রম পরিচালনাকারী দুই শর মতো সুপারশপ আছে। বছরে এসব প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। সুপারশপ থেকে এনবিআর বছরে গড়ে একশ কোটি টাকার মতো ভ্যাট পায়।
শুধু সুপারশপ নয়; করোনা পরিস্থিতিতে সিগারেট ও ওষুধ প্রস্তুতকারকসহ যেসব শিল্প ও সেবাপ্রতিষ্ঠান খোলা রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে মার্চ মাসে কত রাজস্ব আদায় হয়েছে, তা সব ভ্যাট অফিসের কাছে জানতে চেয়েছে এনবিআর। এপ্রিল মাসে কত রাজস্ব পাওয়া যেতে পারে, তারও একটি ধারণা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এনবিআরের সদস্য (মূসক বাস্তবায়ন ও আইটি) মো. জামাল হোসেন বলেন, করোনার কারণে অনেক খাত থেকে রাজস্ব আদায় কমে যাবে, এটা স্বাভাবিক। জরুরি প্রয়োজনে কিছু শিল্প ও সেবা খাত খোলা আছে। আমাদের রাজস্ব দরকার আছে। তাই সুপারশপ, সিগারেট, ঔষুধসহ খোলা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কী পরিমাণ রাজস্ব আসছে, চলতি মাসে কত আসতে পারে, এর ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই এসব তথ্য জানতে চাওয়া হয়েছে।
সিগারেট প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের রাজস্ব আদায়ের বড় খাত। প্রতিবছর গড়ে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসে এ খাত থেকে। যার সিংগভাগই আসে সিগারেটের ব্যান্ডরোল বিক্রি করে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে সিগারেট প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন ও বাজারে বিপনন অব্যাহত আছে। করোনার মধ্যে সিগারেটের উৎপাদন ও বিপননে সহায়তা করতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
অপরদিকে, জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ ছাড়া অন্য সব ঔষুধে ভ্যাট দিতে হয়। তবে এটি গ্রাহক বা ভোক্তাপর্যায়ে নয়। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। আর এই ভ্যাটের টাকা যোগ করেই ঔষুধ প্রশাসন কর্তৃক বেঁধে দেওয়া মূল্য ঘোষণা দেয় ঔষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
ফলে ফার্মেসি বা ভোক্তাপর্যায়ে আলাদা কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। এ ক্ষেত্রে ঔষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকেই ভ্যাট আদায় করে এনবিআর। করোনার পরিস্থিতির মধ্যে ঔষুধ কোম্পানিগুলো ঔষুধ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রেখেছে।
একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, অবরুদ্ধের সময় সব ধরনের সেবা বেড়েছে। আমরা চেষ্টা করছি মানুষকে নিরবিচ্ছিন্ন সেবা প্রদানের। সেবা বাড়লে রাজস্ব বাড়বে এটাই স্বাভাবিক।
এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রথম আট মাসে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত আদায় হয়েছে ১ লাখ ৪৪ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা।
মার্চের হিসাব এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে করোনার মধ্যে জরিমানা মার্চে মাসে রিটার্ন দাখিলে চারদিন দেশের ২৫২টি সার্কেল অফিস খোলা ছিল। এসময় রিটার্ন দাখিল হয়েছে ৩০ হাজার ৭০০। আর রাজস্ব আহরিত হয়েছে ছয় হাজার ২৮৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
rahmatbnews@gmail.com
###