Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 10:28 pm

করোনার প্রথম মাসেই রাজস্ব নেই ১২ হাজার কোটি টাকা

রহমত রহমান: দেশে ৮ই মার্চ প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। তবে সীমিত পরিসরে খোলা ছিল কাস্টমস। আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক রাখতে কাস্টমস খোলা রাখা হয়। কিন্তু আয়কর ও ভ্যাট অফিস বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া সাধারণ ছুটির মধ্যে বন্ধ হয়ে সরকার-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠান। এপ্রিলে করোনা সংক্রমণ বেশ ঝেঁকে বসে। ৫ দফায় বাড়ে সাধারণ ছুটির মেয়াদ।

### নয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৬১৩৮ কোটি টাকা

### সাধারণ ছুটির প্রথম থেকেই সীমিত পরিসরে খোলা কাস্টমস, বর্তমানে পুরোধমে

### রিটার্ন জমায় চারদিন খোলা ছিল ২৫২টি ভ্যাট সার্কেল, বর্তমানে সীমিত

### আয়কর অফিস সীমিত পরিসরে খোলা রয়েছে

সম্প্রতি ষষ্ঠবারের মতো ছুটির মেয়াদ বেড়েছে। মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ শুরু হলেও কার্যত পুরো মার্চ জুড়ে সর্বত্র থাকে অস্থিরতা। কলকারখানাসহ সব ব্যবসায় নামে স্থবিরতা। অচল হয়ে পড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যার ধাক্কা লেগেছে রাজস্ব আহরণে।

করোনার ধাক্কায় শুধু মার্চ মাসেই রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এমনিতেই চলতি অর্থবছর রাজস্ব ঘাটতি পিছু ছাড়ছে না। তার উপর করোনার ধাক্কা যোগ হয়ে ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৬ হাজার কোটি টাকা।

মার্চে কিছুটা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলেও এপ্রিলে ছিল একেবারেই স্থবির। আর পুরো এপ্রিল জুড়ে দেশে করোনা মহামারির তাণ্ডব অব্যাহত ছিল। ফলে এপ্রিল মাসে ঘাটতি মার্চের দ্বিগুণের বেশি হতে পারে বলে হিসেব ধারণা করছেন এনবিআর কর্মকর্তারা।

এনবিআরের হিসেব অনুযায়ী, আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক কোন খাত থেকেই কাঙ্খিত রাজস্ব আহরণ হয়নি। অর্থবছরের নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) সব মিলিয়ে এক লাখ ৬৫ হাজার ৭ কোটি ৮৯ লাখ টাকার কর আদায় হয়েছে, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ১৪৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ ৫৬ হাজার ১৩৮ কোটি ৮ লাখ টাকা ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

তবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। নয় মাসে শুল্ক খাতে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি মাত্র ২ দশমিক ২৫ শতাংশ।

যেখানে গতবছর একই সময়ে ছিল ৩ দশমিক ২২ শতাংশ। ভ্যাটে ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ, যেখানে গতবছর একই সময় ছিল ৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর আয়কর খাতে প্রবৃদ্ধি ১৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ, যেখানে গতবছর একই সময় ছিল ১২ দশমিক ২৭ শতাংশ।

অপরদিকে, চলতি অর্থবছর নয় মাসে শুল্ক আদায়ে লক্ষ্যের চেয়ে ২০ হাজার ২৬০ কোটি ২৭ লাখ টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর। আয়করে ঘাটতি ১৮ হাজার ৪১৫ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ভ্যাটে ১৭ হাজার ৪৬২ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ সময়ে মোট এক লাখ ৫৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় হয়েছিল।

হিসেবে আরো দেখা যায়, গত পাঁচ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে গড়ে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু এবার প্রবৃদ্ধি ১-২ শতাংশ হবে কিনা-তা নিয়েই সংশয় দেখা দিয়েছে। মার্চ মাসে আহরণ প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৬ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা গতবছরের মার্চ মাসের চেয়ে ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম।

মার্চ মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১ হাজার ৩২২ কোটি ৯২ লাখ টাকা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১ হাজার ৯৫৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা কম আদায় হয়েছে। এর মধ্যে আয়করে ঘাটতি ৫ হাজার ৩১০ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর ভ্যাট খাতে ঘাটতি ৩ হাজার ৭৫১ কোটি ৭৯ লাখ ও শুল্ক খাতে ঘাটতি ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। অর্থাৎ মার্চ মাসে আয়কর খাতে সবচেয়ে বেশি ঘাটতি রয়েছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, ২৫ মার্চ থেকে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান শাটডাউনে হয়ে যায়। কিন্তু নতুন মূসক আইন অনুযায়ী, প্রতিমাসের ১৫ তারিখের মধ্যে রিটার্ন জমা না দিলে ১০ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। অর্থাৎ মার্চ মাসের রিটার্ন ও ভ্যাট এপ্রিল মাসের ১৫ এপ্রিলের মধ্যে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

করদাতাদের জরিমানা এড়াতে ও আইনি বাধ্যবাধকতা থাকায় ১২ থেকে ১৫ এপ্রিল চারদিন ভ্যাটের ২৫২টি সার্কেল খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এনবিআর। ৯ এপ্রিল এ বিষয়ে নির্দেশনা জারি করে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত সার্কেল অফিস খোলা থাকে। করোনার ঝুঁকি থাকলেও অফিস খোলা রাখার ফলও আসে।

চারদিনে ৩১ হাজার রিটার্ন দাখিল ও প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণ হয়। যার ফলে মার্চ মাসে ভ্যাট খাতে ঘাটতি কম হয়েছে, বেড়েছে প্রবৃদ্ধি। এছাড়া ২৫ মার্চ পর‌্যন্ত ভ্যাট অফিস খোলা ছিল। এসময় ভ্যাট আদায় হওয়ায় ভ্যাট খাতে মার্চ মাসে ঘাটতি কম ছিল।

একইভাবে মার্চ মাসে কাস্টমস হাউসে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক ছিল। ফলে ঘাটতি কম। তবে মার্চ মাসে আয়করে ঘাটতি কিছুটা বেশি। এপ্রিল মাস পুরোপুরি লকডাউন থাকায় আয়কর খাতে মার্চে ঘাটতি বেশি হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

এনবিআরের একজন সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, এপ্রিল মাসে ঘাটতি পুরো অর্থবছরের যেকোন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে। প্রথম অবস্থায় কাস্টমস সীমিত আকারে দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, ওষধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম খালাসে কাস্টমস খোলা রাখা হয়।

করোনার ঝুঁকি থাকায় এসময় অন্য পণ্য খালাসে এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। পরবর্তীতে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে পুরোধমে আমদানি-রপ্তানি চালুর নির্দেশনা দেওয়া হয়। কাস্টমস খোলা থাকলেও সেইভাবে রাজস্ব আহরণ হয়নি।

তিনি বলেন, আর আয়কর অফিস পুরো মাস জুড়ে বন্ধ ছিল। এছাড়া হয়নি ব্যবসা-বাণিজ্য। ফলে এপ্রিলে আয়কর খাতেও বেশ ভালো ঘাটতি হবে। আর লকডাউনে দোকান, শপিংমল থেকে শুরু করে প্রায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। সেক্ষেত্রে এপ্রিলে ভ্যাট আহরণ কিছুটা কম হবে।

তিনি আরো বলেন, লকডাউনের মধ্যেও ওষধ উৎপাদন ও বাজারজাত, মোবাইল সেবা, সুপারশপ, সিগারেট উৎপাদন-বিপনন, কিছু খাদ্য পণ্য উৎপাদন ও বিপনন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবাসহ বেশ কিছু খাতে আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। ফলে এপ্রিলে এসব খাতে আগের যেকোন সময়ের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশি ভ্যাট আহরণ হবে। এতে ভ্যাট রাজস্বে কিছুটা আশার আলো থাকছে।

আরো পড়ুন-চারদিনে রিটার্ন ৩১ হাজার রাজস্ব ছয় হাজার কোটি [1]

আরো পড়ুন-রাজস্বে আশা দেখাবে সিগারেট, ঔষধ, সুপারশপ, মোবাইল [2]

আরো পড়ুন-সাত মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৩৭ হাজার কোটি টাকা [3]

আরো পড়ুন-চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রাজস্ব ঘাটতি ৯৩২১ কোটি টাকা [4]

আরো পড়ুন-করোনা ‘যোদ্ধা’ কাস্টমস [5]

আরো পড়ুন-সুরক্ষা ছাড়াই শুল্কায়ন, ঝুঁকিতে কাস্টমস কর্মকর্তারা [6]

আরো পড়ুন-সব পণ্য শুল্কায়ন ও খালাসে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার [7]

রাজস্ব ঘাটতি বিষয়ে সিপিডির সিনিয়র রিসার্স ফেলো ড. তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি ভালো নয়। গত অর্থবছরে ৮৭ হাজার ৪০২ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল। বছরের শুরুতে সিপিডি মনে করেছিল এ অর্থবছরেও এ ঘাটতি ৮৫ হাজার কোটি টাকার মধ্যে থাকবে। কিন্তু রাজস্ব আদায়ের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, করোনা ছাড়াই ঘাটতি ১ লাখ কোটি টাকা হবে। এরপর করোনার কারণে এটি লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে এটি সহজেই বলা যায়। এছাড়াও চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি হবে সাড়ে ৫ শতাংশ।

rahmatbnews@gmail.com, rahmatbnews@yahoo.com

###