সাইফুল আলম, চট্টগ্রাম: খাতুনগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী অসীম কুমার দাশ। যিনি নিয়মিত মশলা জাতীয় ও শুকনা খাদ্যপণ্য আমদানি করে থাকেন। প্রতিবছরের মতো আসন্ন রমজানে পাইকারী বাজারের খেজুর বিক্রয়ের জন্য মিশর থেকে গত ফেব্রয়ারিতে তিন কনটেইনার (৭৫ মেট্রিক টন) খেজুর ক্রয় করেন, যা ১৯ মার্চ মিশর থেকে জাহাজীকরণ করা হয়। আর জাহাজটি সিঙ্গাপুরে আসবে ৬ এপ্রিল। অপরদিকে চট্টগ্রাম বন্দরের চলমান বার্থি সংকট ও কনটেইনার ইয়ার্ড সংকট এবং চলমান লকডাউনের কারণে ৩২দিন বন্ধ থাকবে শিপমেন্ট। ফলে আগামী মাসে ৮ মে সিঙ্গাপুর থেকে চট্টগ্রামগামী জাহাজ বোঝাই হবে এসব কনটেইনার। জাহাজটি চট্টগ্রামে আসবে ১৪ মে এবং বন্দর ও খালাস প্রক্রিয়া শেষ করে খাতুনগঞ্জে আসবে ২৪ মে। অর্থাৎ রমজান শেষ হয়ে যাবে। ফলে রমজানের ব্যবসা করতে পারবে না অসীম এন্টারপ্রাইজ। একই জাহাজে অসীম এন্টারপ্রাইজের সাথে আরো দুই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চারটি কনটেইনার আসার কথা। অর্থাৎ একশ মেট্রিক টন। তারাও বিপাকে আছেন।
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ রোগের বিস্তার ঠেকাতে দেশে বন্ধ রাখা হয় সকল ধরনের বাণিজ্যিক ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। সীমিত করা হয় কাস্টমস ও ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম। কিন্তু দেশের আমদানি ও রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে চালু ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচলন। এ সময়ে বন্দরের জেটিতে পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য উঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও বন্দর ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি অস্বাভাবিকভাবে কমছে। এই কয়েকদিনে ইয়ার্ডে ধারণ ক্ষমতার কাছাকাছি কনটেইনার জমে যায়। ফলে বন্দরের প্রয়োজনী জায়গা সংকটের কারণে জাহাজ হ্যান্ডেলিং কম হচ্ছে। এদিকে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সাধারণ ছুটির মেয়াদ। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বন্দরের পরিচলন কার্যক্রমে। আর এসব বিবেচনা করে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও পোর্ট কেলাং থেকে চট্টগ্রাম বন্দরমুখী জাহাজের শিডিউল পরিবর্তন করা হচ্ছে ফলে শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরির শঙ্কা বন্দর ব্যবহারকারীদের।
চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন শাখা সূত্রে জানা যায়, শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটা পর্যন্ত বন্দরের বিভিন্ন জেটি, বিশেষ বার্থ ও আউটার এনকারেজে মোট খালাসযোগ্য জাহাজ ছিল ১০৭টি। এরমধ্যে ৭২টি জাহাজ থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাসে কাজ চলছিল। আর ৩৫টি জাহাজ থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাস হয়নি। একইদিনে বন্দর ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার ছিল ৪৪ হাজার ৪৯৬ টিইইউএস। আর আমদানি ও রফতানিবাহী জাহাজে মোট কনটেইনার হ্যাডেলিং হয়েছিল চার হাজার ২৫টিইইউএস। একই সময়ে বন্দর থেকে ডেলিভারি হয়েছিল দুই হাজার ১৮ একক কনটেইনার।
অপরদিকে গত ২৩ মার্চ এগারাটায় চট্টগ্রাম বন্দরের মোট খালাসযোগ্য জাহাজ ছিল ৭৯টি। এরমধ্যে ৬১টি জাহাজ থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাস করা হয়েছিল। আর ১৮টি জাহাজ থেকে কার্গো ও কনটেইনার খালাস হয়নি। একইদিকে বন্দর ইয়ার্ডে মোট কনটেইনার ছিল ৩৩ হাজার ১২০ টিইইউএস। আর আমদানি ও রফতানিবাহী জাহাজে মোট কনটেইনার হ্যাডেলিং হয়েছিল ছয় হাজার ৪৩৮ টিইইউএস। একই সময়ে বন্দর থেকে কনটেইনার ডেলিভারি হয়েছিল দুই হাজার ৭৬৫ টিইইউএস বা একক কনটেইনার।
শনিবারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে খালাসের জন্য তৈরিকৃত কিন্তু খালাস হচ্ছে না ৩৫টি জাহাজের মধ্যে আছে ১৩টি তেলবাহী জাহাজ, ১১টি কনটেইনার জাহাজ, ৬টি ক্লিংকারবাহী জাহাজ, তিনটি সাধারণ কার্গোবাহী এবং ২টি ফুড গেইন জাহাজ। এছাড়া ১৩টি পুরাতন (স্ক্র্যাব) আমদানিকৃত জাহাজ আছে। এতে বুঝা যায় রেফাইনারী, সিমেন্ট কারখানা, পুরাতন জাহাজ কাটাসহ অন্যাণ্য ভারি মিল্প প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে স্থবির হয়ে আছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত পুরো পৃথিবী। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। চলমান ১৫ দিনের লকডাইনে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর ২৪ ঘন্টা চালু আছে। কারণ এ বন্দর দিয়ে আমদানি ও রপ্তানির ৯২ শতাংশ বাণিজ্যিক কার্যক্রম হয়ে থাকে। এ সময়ে বন্দরের জেটিতে পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য উঠানামা স্বাভাবিক আছে। তবে বন্দর ব্যবহারকারীদের প্রয়োজনীয় জনবল ও চাহিদা না থাকার কারণে বন্দর ইয়ার্ড থেকে কনটেইনার ডেলিভারি গ্রহণ কমে গেছে। গত দশদিনে কনটেইনার ইর্য়াডে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত কনটেইনার জমে গিয়েছে। এ সময়ে বন্দর থেকে পণ্য সরবরাহে নেমেছে ধস। এদিকে আগামী ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে সাধারণ ছুটির মেয়াদ। আর প্রায় শিল্প প্রতিষ্ঠান তো বন্ধ, পরিবহন ও শ্রমিক সংকট। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বন্দরের পরিচলন কার্যক্রমে।
আমদানিকারক ও জুনিয়র চেম্বার কসমপলিটনের সাবেক সভাপতি অসীম কুমার দাশ শেয়ার বিজকে বলেন, আমার ফেব্রুয়ারি মাসে বুকিংকৃত খেজুর দেশে আসত রমজানের আগে। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে লকডাইন ও বন্দরের কনটেইনার জটের কারণে আসবে প্রায় রমজানের শেষের দিকে। তখন এসব খেজুরের চাহিদা থাকবে না। ফলে রমজানে ব্যবসা করতে পারব না। যা আমাকে এক বছরের জন্য কোল্ডস্টোরে রাখতে হবে। এতে আমার ব্যয় ও বিনিয়োগকৃত টাকা দীর্ঘসময়ের জন্য আটকে থাকবে। কারণ মানুষ সব সময় তো খেজুর খায় না। তিনি আরো বলেন, রমজানের সময় বিক্রয় করতে না পারলে দশ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত লোকসান হতে পারে, যা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।
ব্যাংকিং লেনদেন ও এলসি খোলা বিষয়ে ফাষ্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নেয়ামত উল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, এলসি খোলা ও নেগোসিয়েশনের কাজ স্বাভাবিক সময়ের মতো আছে। ডিএইচএলসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তো সময়মতো আসছে। আর চলতি সপ্তাহে আরো এক ঘন্টা ব্যাংকিং লেনদেন বাড়ছে। তবে বেশিভাগ প্রতিষ্ঠান পরিস্থিতি অর্যবেক্ষন করছে। ফলে তারা কনটেইনার ও কার্গো সময়মতো রিসিভ করতে পারছে না। কারণ আগে সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়।
নাম প্রকাশে অনচ্ছিুক একজন বড় আমদানিকারক শেয়ার বিজকে বলেন, এখন তো করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব পরিস্থিতি ভালো না। প্রতিনিয়ত সকল ধরণের তেল, চিনি, এলএনজি গ্যাস, ডালসহ অনেক ধরনের পণ্যেও দাম কমছে। আমরা আগে বেশি দামে এসব পণ্য কিনেছি, যা দেশের বাজারের সরবরাহ আছে। এরমধ্যে আরো পণ্য কম দামে কিনেছি সেগুলো শিপমেন্ট হয়েছে। কিন্তু দেশে আসেনি। এরমধ্যে বন্দরের জাহাজ ও কনটেইনারজট দেখা দিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি অনুসারের বন্দরের সংকট আরো কয়েক মাস থাকবে। তাহলের সঠিক সময়ে পণ্য বুঝে পাব না। এতে আমাদের ক্ষতি ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। এখানো বলা যায়, যার যত বেশি আমদানি কিংবা ব্যবসা, সেই ততবেশি লোকসানে পড়বে।
####