Print Date & Time : 22 June 2025 Sunday 9:21 am

করোনার মধ্যেও তিন হাজার কোটি টাকার ফোর্সড লোন

জয়নাল আবেদিন: কভিড-১৯-এর কারণে বছরের প্রায় শুরু থেকেই বন্ধ ছিল ব্যাংকের বেশিরভাগ কার্যক্রম। স্থবির হয়ে পড়েছিল আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণসহ সব ধরনের কাজ। বর্তমানে কিছুটা গতি এলেও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি এখনও। এই চাপের মধ্যেও বড় গ্রাহকদের অনুকূলে তিন হাজার ১৮০ কোটি টাকার ফোর্সড লোন তৈরি করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক। সংশ্লিষ্টদের মতে, দিনের পর দিন খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির এটাও একটা অন্যতম কারণ।

পণ্য আমদানির (ঋণপত্র বা এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংক। দেশে আমদানি পণ্য আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করলে ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে দেয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক কোনো কারণে অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে। ওই অর্থে ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা শোধ করে। এভাবে ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে। মূলত আমদানির বিপরীতেই এসব ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই হাজার ৮০৭ কোটি টাকার ফোর্সড লোন তৈরি করেছে জনতা ব্যাংক, যা আগের ছয় মাসের তুলনায় কিছুটা কম। ডিসেম্বরে ব্যাংকটির ফোর্সড লোনের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি প্রায়ই বন্ধ ছিল। নতুন করে শুরু হয়েছে আমদানি-রপ্তানি। এই প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হলে ফোর্সড লোন আরও বাড়তে পারে।

তথ্যমতে, একই সময়ে রূপালী ব্যাংক ফোর্সড লোন তৈরি করেছে ১৯৩ কোটি ৫০ লাখ টাকার, ডিসেম্বর পর্যন্ত যার পরিমাণ ছিল ৪৯৮ কোটি টাকার। অন্যদিকে সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকের ফোর্সড লোন তৈরি করার অঙ্কটা ছিল ১৩৫ কোটি এবং ৪৪ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে আলোচ্য সময়ে তিন হাজার ১৭৯ কোটি ৬৮ লাখ টাকার ফোর্সড লোন তৈরি করা হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি, ব্যাংকারদের যোগসাজশ এবং আগ বাড়িয়ে ফোর্সড লোন তৈরিসহ নানা কারণে দিনের পর দিন খেলাপি ঋণ বেড়ে চলেছে বলে মত বিশ্লেষকদের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যানমতে, গত জুন শেষে খেলাপি ঋণ আগের তিন মাসের চেয়ে তিন হাজার ৬০৬ কোটি টাকা বেড়ে হয়েছে ৯৬ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ। গত মার্চে যা ছিল মোট ঋণের ৯ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, প্রকৃত খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। ব্যাংক খাতে অনাদায়ী ঋণ অনেক বেড়ে গেছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে তা খেলাপি করা যাচ্ছে না। কারণ চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধ না করলেও গ্রাহককে খেলাপি না দেখানোর নির্দেশনা রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের।

ব্যাংকাররা বলছেন, প্রতি বছরই তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ফোর্সড লোন। এসব ঋণের মধ্যে মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে খেলাপিতে পরিণত হওয়ার উদাহারণও কম নয়। করোনার কারণে ফোর্সড লোনের আকার এখন ছোট দেখালেও প্রকৃত চিত্রটা আলাদা। এই ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। সাধারণত পণ্য আমদানির বিপরীতে ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়। কোনো গ্রাহক আমাদানি বিল পরিশোধ করতে না পারলে তার নামে ঋণ সৃষ্টি করে বিদেশি ব্যাংককে টাকা পাঠিয়ে দেয় দেশি ব্যাংক। অনেক গ্রাহক আছেন যারা এই বিশ্বাসের অবমূল্যায়ন করেন।

এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামস-উল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, ফোর্সড লোনটা অবৈধ কিছু নয়। যেখানে একটি ব্যাংকের আট হাজার কোটি টাকার রপ্তানি হয়, সেখানে কিছু ফোর্সড লোন তৈরি হওয়াটা স্বাভাবিক। এলসির সময় শেষ হওয়ার আগে টাকা পরিশোধ না করলে কান্ট্রি রেটিং খারাপ হয়। এই ঋণটা যাতে খেলাপি না হয়, সেদিকে সাংঘাতিকভাবে খেয়াল রাখছি আমরা। যুক্তিহীনভাবে ফোর্সড লোন যাতে চলে না যায়, সে বিষয়ে বোর্ডের কড়া নির্দেশনা রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, স্বাভাবিকভাবেই ফোর্সড লোন ভালো জিনিস নয়। তবে ঋণগুলো যদি আমদানি-রপ্তানির বিপরীতে হয়ে থাকে তাহলে ভালো। কারণ করোনা-পরবর্তী সময়ে রপ্তানি বৃদ্ধি পেলে দেশেরই লাভ। এখানে সমস্যা হলো এক ব্যাংকে ফোর্সড লোনের সুবিধা পেলে অন্য ব্যাংকেও গ্রাহকরা দাবি করে। নিজেদের লাভের কথা চিন্তা করেই ব্যাংকগুলো এই সুবিধা দিয়ে থাকে। ঋণগুলো যাতে খেলাপিতে পরিণত না হয়, সেদিকে কড়া নজরদারির পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।