শামীমা চৌধুরী: ‘এই পেশায় এসেছি মানুষকে সেবা দেয়ার জন্য, তাহলে সেই মানুষদের বিপদের দিনে কেন পাশে থাকব না? আমাদের দুঃসময়ে থাকতে হবে মানুষের পাশে। আর এ কারণেই আমার করোনা ইউনিটে আসা। জানি যেকোনো মুহূর্তে আমিও সংক্রামিত হতে পারি, তাই বলে মানুষ সেবার ময়দান থেকে পালিয়ে যাব, তা তো হয় না। করোনা আমাদের আরও প্রত্যয়ী হতে শিখিয়েছে।’
কথাগুলো বলছিলেন এক মানব দরদি নার্স শামসুন্নাহার। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) করোনা ইউনিটের সিনিয়র নার্স। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ সময় তিনি ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ নার্স। সারাবিশ্বের মানুষ যখন করোনার ভয়াবহ করাল গ্রাসের শিকার, বাংলাদেশও তখন এর ব্যতিক্রম ছিল না। সে বছর মার্চের প্রায় প্রথম সপ্তাহে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে করোনা সংক্রমণ। শুরুতেই চিকিৎসক, নার্স, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জড়িতরা বেশি আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। সেই ভয়াবহ সময়ে তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে তাকে করোনা ইউনিটে দায়িত্ব দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বিস্মিত হন কর্তৃপক্ষ। কারণ শামসুন্নারের বয়স। মধ্যবয়সী শামসুন্নাহের জন্য কাজটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সে সময় নার্স ও চিকিৎসকদের সুরক্ষাসামগ্রীও তেমন ছিল না। ভ্যাকসিন ছিল না। সেই থেকে অদম্য সাহস আর দরদি হƒদয়ে তিনি করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এক সময় মানুষ মনে করত আমরা করোনা জীবাণু ছড়াচ্ছি। এমন অনেক নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে। এখন প্রমাণিত, চিকিৎসকদের পাশাপাশি আমাদের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। শুরুর দিকে অনেক সমস্যা ছিল। হাসপাতালে ছিল নানা সংকট। অনেক ভর্তি রোগীদের আত্মীয়স্বজনরা তেমন দেখতে আসত না। আমাদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিত। তাদের সেই অসহায় অবস্থায় আমরাই ছিলাম ভরসা। করোনা রোগীর কাছে থাকার কারণে পরিবারে সমাজে অনেক হেনস্তার শিকার হয়েছি আমি ও আমাদের পেশার অনেকে। আত্মীয়স্বজন এড়িয়ে চলত। বাসায় আলাদা থাকতে হতো। কিন্তু পিছু হটিনি। এখন সবাই উপলব্ধি করতে পারছে, আমাদের সেবা কতখানি জরুরি। এখন তো ১৪ হাজারের বেশি নার্স করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।’
শুধু শামসুন্নাহার একা নন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের তেরেজা বাড়ৈ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চন্দনা রানী হালদারসহ আরও অনেক নার্স এই দুঃসময়ে করোনা রোগীদের সেবা করে গেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব নার্সেস সূত্রে জানা যায়, শুরু থেকে ৩১ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত বিশ্বের ৫৯টি দেশের ২ হাজার ৭১০ জন নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) সূত্রমতে, বাংলাদেশে ৩ হাজারের বেশি নার্স করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন ২৫ জন। এটি সরকারি হাসপাতালের চিত্র। বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত বহু নার্স মারা গেছেন করোনায়।
বিএনএ’র সভাপতি ও সেবা মহাবিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ইসমত আরা পারভিন জানান, সরকারি হাসপাতালে প্রায় ৩৮ হাজার আর বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ২৭ হাজার নার্স কাজ করেন। তবে চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যা অপ্রতুল। শয্যার অনুপাতে দেশে আরও ৮০ হাজার নার্স নিয়োগ দেয়া দরকার। করোনার কারণে এটি দৃশ্যমান এখন। সরকার নার্সদের দ্বিতীয় শ্রেণির পদমর্যাদায় উন্নীত করার কারণে দেশে এখন এই পেশায় আসার হার বাড়ছে। এখন করোনা কমলেও আক্রান্ত বৃৃদ্ধির আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ কারণে এই পেশায় আরও লোকবল দরকার।
এই পেশার উন্নয়নে বর্তমান সরকার প্রবল আন্তরিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে ১৯৯৮ সালে নার্সিং অনুষদসহ অন্যান্য অনুষদ নিয়ে আইপিজিএমআরকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। নার্সিং অনুষদের কার্যক্রম শুরু হয় আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্স দিয়ে। ২০১৬ সালে ঢাকার মুগদায় নার্সিংয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড নার্সিং এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্স’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানে ৬টি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়। বর্তমানে দেশে রেজিস্টার্ড নার্স-মিডওয়াইফারির সংখ্যা ৫৬ হাজার ৭৩৩ জন। সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অধীনে কর্মরত নার্সের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মিডওয়াইফারি ১ হাজার ৫০০ জন। সরকারি নার্সিং কলেজের সংখ্যা ১৭টি, বেসরকারি ৬০টি। সরকারি নার্সিং ও মেডওয়াইফারি ইনস্টিটিউটের সংখ্যা ৪৩টি ও বেসরকারি ১২০টি।
বাংলাদেশ নার্সিং কউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘একটি সিনিয়র নার্সিং স্কুল আর ৬০০ রেজিস্টার্ড নার্স নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু, আজ সেটির অর্জন নেহাত কম নয়। এটি বর্তমান সরকারের আন্তরিকতার ফল।’ শামসুন্নাহারও মনে করেন, ‘সরকারি সহযোগিতা আমাকে আরও সেবামুখী করেছে। তবে সবার আগে দরকার মানবতাবোধ, যা এই পেশার প্রথম পাঠ।’ তাই করোনায় অবদানের জন্য তো বটেই, মানবসেবায় নিয়োজিত নার্সিং পেশার এই দৃঢ় প্রত্যয়ী নারীদের সশ্রদ্ধ সালাম।
পিআইডি নিবন্ধ