করোনা ঝুঁকিতে চট্টগ্রামের চালু ৮০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান!

সাইফুল আলম ও মোহাম্মদ আলী, চট্টগ্রাম: দেশব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ৪২ দিনের লকডাউন চলছে। লকডাউন চলাকালেও প্রথম দিকে কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চালু হয়ে যায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এতে নারায়ণগঞ্জ ও সাভারের মতো শ্রমিকঘন অঞ্চলগুলোয় করোনায় আক্রান্ত হয় প্রায় শতাধিক শ্রমিক।

এসব অঞ্চলের মতো চট্টগ্রামও একটি শ্রমিকঘন শিল্পাঞ্চল। এ অঞ্চলের প্রায় ৮০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। এতে ৫০ শতাংশের মতো শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছে। অথচ প্রতিনিয়ত দেশে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। আর ঝুঁকির মধ্যে চালু থাকায় বাড়তে পারে করোনা সংক্রমণ, যা নিয়ে সচেতন মহল রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করছে।

বাংলাদেশ শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দেশের প্রধান বাণিজ্যিক শহর চট্টগ্রাম। সমুদ্রবন্দরের সহজলভ্যতা এবং ভৌগোলিক অবস্থান ও অবকাঠামোগত সুবিধার জন্য এ শহরে পোশাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, জাহাজ ভাঙা শিল্প, রিফাইনারিসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান মিলে এক হাজার ২০২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে রয়েছে বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠান ৩৩৫টি, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াঞ্চল কর্তৃপক্ষের আওতাধীন ২২২টি, বিকেএমইএ’র সদস্য প্রতিষ্ঠান ৫৬টি, বিটিএএ’র সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠান ২৭টি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ৫৬২টি। এসব কারখানায় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ শ্রমিক কাজ করে। এসব কারখানা থেকে গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭ হাজার ১৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় এসেছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) বর্তমানে ১৪৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে। এ মুহূর্তে সিইপিজেডে ১০৪টি প্রতিষ্ঠান খোলা আছে। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিকসংখ্যা ৫২ হাজার ৬০০। অন্যদিকে চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গায় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কর্ণফুলী ইপিজেডে ৪১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে।

কর্ণফুলী ইপিজেডে এ মুহূর্তে ৩০টি প্রতিষ্ঠান খোলা আছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মসিউদ্দিন বিন মেজবাহ। এসব প্রতিষ্ঠানের ২৫ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছে। এছাড়া পোশাকে খাতের সংগঠন বিকেএমইএ’র সদস্যভুক্ত ৫৭টি প্রতিষ্ঠান চালু আছে। আর বিজিএমইএ’র সদস্যভুক্ত ৩৫১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫০টি চালু আছে। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত নয়, এমন শতাধিক পোশাক কারখানাও চালু করেছে তাদের প্রতিষ্ঠান।

অর্থাৎ পোশাক খাতের ৭৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। অপরদিকে জাহাজ ভাঙার ৬০টি প্রতিষ্ঠানেও চালু রয়েছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আর চট্টগ্রাম অঞ্চলের সব ইস্পাত কারখানা, সিমেন্টশিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোপুরি চালু আছে বলে জানা যায়। অর্থাৎ জাহাজ ভাঙা শিল্প, ইস্পাত কারখানা, সিমেন্টশিল্প ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় শতভাগ চালু আছে।

চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজের একাধিক প্রতিনিধি ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা শেয়ার বিজকে বলেন, চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বাণিজ্যিক শহর। ফলে স্বাভাবিকভাবে শ্রমিকশ্রেণির বসবাস বেশি। আর ৭০ লাখ নাগরিকের জন্য চিকিৎসাসেবা খুবই কম। এর মধ্যে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা পুরোপুরি বন্ধ। আর সরকারিভাবে প্রতিদিন মাত্র দুই ল্যাবে দুই শতাধিক মানুষের করোনা শনাক্ত করা হচ্ছে।

এখনও চালু হয়নি করোনা চিকিৎসায় ভেন্টিলেটরসমৃদ্ধ আইসিইউ বেড। এর মধ্যে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু হয়েছে। এ অবস্থায় কয়েকজন শ্রমিক যদি কোভিট-১৯-এ আক্রান্ত হয়, সেক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণ বাড়ার ঝুঁকি বহু গুণ বেশি এবং তাদের চিকিৎসা দেওয়া ক্ষমতা নেই। এর ফলে মানবিক সংকট তৈরি হবে। সুতরাং প্রশাসনের উচিত পরিস্থিতি যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে প্রতিষ্ঠান চালুর নির্দেশনা দেওয়া। কারণ আগে জীবন, পরে শিল্প।

সিইপিজেডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে জানান, শ্রমিকদের কারখানায় ঢোকানোর সময় যেসব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখা, দূরুত্ব বজায় রেখে ঢোকা, কারখানার ভেতরে শ্রমিক থেকে শ্রমিক এক মেশিন বাদ দিয়ে দূরুত্ব বজায় রাখা, শ্রমিকদের মাস্ক দেওয়া, হ্যান্ডগ্লাভস দেওয়া, ফেসশিল্ড দেওয়া, জ্বর পরিমাপ করা, জীবাণুমুক্ত করে ঢোকানো প্রভৃতি। অর্থাৎ সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সবকিছু মানা হচ্ছে।

সরকারি গাইডলাইন মানা হচ্ছে। সরকারি গাইডলাইন যেসব কোম্পানি মানছে না, তাদের আমরা অ্যালাউ করছি না। আর মে মাসের বেতন ও ঈদের বোনাস সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মে মাসের বেতন ও ঈদের বোনাস দেওয়া হবে। এখনও তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। প্রতি বছর ঈদের ১০ দিন আগে বেতন ও বোনাস দেওয়ার সার্কুলার দেওয়া হয়। এবারও সার্কুলার দেওয়া হবে। এ সপ্তাহের মধ্যেই সার্কুলার দেওয়া হবে, যা সরকারি সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

এ বিষয়ে বিকেএমইএ’র সিনিয়র যুগ্ম সচিব আলতাফ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, গত ২৫ এপ্রিল সরকারি নিদের্শনা ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসারে শ্রমিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে আমাদের সদস্যভুক্ত পোশাক কারখানাগুলো চালু আছে। প্রতিনিয়ত শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়টি আমরা নজরদারি করছি। এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানে একজনও করোনায় আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে মার্চ মাসের বেতন দেওয়া হয়েছে। আর এপ্রিলের বেতন সরকারের প্রণোদনার টাকা পাওয়ার পর দেওয়া হবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিক সুরক্ষার জন্য কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামভিত্তিক পোশাক খাতের শিল্পগ্রæপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সরকারি নির্দেশনা অনুসারে সবকিছু মানা হচ্ছে। পুরোপুরিভাবে সরকারি গাইডলাইন মানা হচ্ছে। কারণ আমাদের সবার নিরাপত্তা আগে বিবেচ্য। এছাড়া আমাদের প্রায় হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে।

সুতরাং আপনাদের চেয়েও আমাদের চিন্তা আরও বেশি। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বেতন-বোনাসের চাপ আসবে, এটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি। এমনিতে অনেক চাপে আছি। এ পরিস্থিতি থেকে দ্রুত সময়ে উত্তরণ না হলে আগামীতে ভয়াবহ অবস্থা সৃষ্টি হবে। আর যদি অর্থনীতি সচল না থাকে, সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী হবে চিন্তাও করতে পারবেন না।

ইস্পাত খাতে বিগ জায়ান্ট বাংলাদেশ স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (বিএসআরএম) চেয়ারম্যান আলী হোসেন আকবর আলী শেয়ার বিজকে বলেন, প্রথম দিকে আমাদের মিল ১০ ঘণ্টা চালু ছিল। প্রতিনিয়ত চাহিদা কমায় এখন পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ। আর বিক্রয় তো ৮০ শতাংশ কমেছে। এভাবে মাস দুয়েক চললে শুধু আমরাই নই, ছোট-বড় সবাই ভয়াবহ সংকটে পড়বে। এ জন্য সরকারের প্রণোদনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। আর অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান শ্রমিকের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করবে, সেসব প্রতিষ্ঠান দ্রুত চালু করার অনুমতি পেতে পারে। পাশাপাশি সব ধরনের নির্মাণকাজ চালু করার উদ্যোগ নিতে পারে। এতে অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যাবে।

করোনা ঝুঁকিতে শিল্পপ্রতিষ্ঠান চালু এবং শ্রমিকের অংশগ্রহণের বিষয়ে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করোনা সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা আছে। যত বেশি লোক সমাগতম হবে, করোনা সংক্রমণ তত বেশি বাড়বে। তবে একই সঙ্গে দেশের অর্থনীতির চাকাও সচল রাখতে হবে। আমাদের সমন্বয়সাধন করে চলতে হবে। গার্মেন্ট মালিকদের অনেক কিছু করার আছে। গার্মেন্ট মালিকরা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ঢোকাবে, শ্রমিকদের এক মেশিন বাদ দিয়ে বসাতে হবে।

আরও বেশি গ্যাপিং করে অর্ধেক ক্ষমতায় যদি চালাতে পারে, তাহলে ভালো। লোকজন যাতে ঠেলাঠেলি করে বের না হয়। ঢোকা ও বের হওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি ঝামেলা হয়। আর বাসে করে যাওয়ার সময় ফাঁক ফাঁক করে বসবে। ৫০টি সিটে ২৫ জন বসবে। সবচেয়ে বড় কথা স্ক্রিনিং করতে হবে। যারা একটু সন্দেহভাজন হবে, তারা আর কারখানায় আসবে না, স্বাস্থ্য বিভাগকে জানাবে আর আইসোলেশনে চলে যাবে এবং পরীক্ষা করা হবে।’

কোনো নির্দেশনা দিয়েছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টসহ শিল্পকারখানাগুলোয় স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়ে বিভাগীয় কমিশনার চিঠি দিয়েছেন। তিনি বিষয়টি দেখছেন। আমরাও অবজারভেশন করছি।’

এ বিষয়ে শিল্প পুলিশ-৩-এর পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পালের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। ফলে মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০