সিপিডির পর্যালোচনা

করোনা থেকে উত্তরণ টেকসই হচ্ছে না

নিজস্ব প্রতিবেদক: চলমান কভিড মহামারিকালে বিশ্বের সব দেশই বড় ধাক্কা খেয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উত্তরণ হচ্ছে। কিন্তু এ উত্তরণ কতটা টেকসই হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে। পাশাপাশি উত্তরণ ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের তরফ থেকে যে ধরনের বাজেটীয় আর্থিক উদ্যোগ (ফিসক্যাল স্পেস) নেয়ার সুযোগ ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ সরকারের আর্থিক সংগতি ধীরে ধীরে দুর্বল হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতকে চাঙ্গা করার জন্য সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সেবাপ্রাপ্তি সহজতর করতে হবে। আর আগামী বোরো মৌসুমে যাতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে না যায়, সেজন্য ডিজেলের দাম কমাতে হবে। পাশাপাশি আর্থিক ও বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। এছাড়া পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক পর্যালোচনায় এ কথা জানানো হয়। রাজধানীর ধানমন্ডিতে সংগঠনটির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থনীতির পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। ‘স্টেট অব দ্য বাংলাদেশ ইকোনমি ইন ফাইন্যান্সিয়াল ইয়ার ২০২১-২২: ফার্স্ট রিডিং’ শীর্ষক এ পর্যালোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বক্তব্য দেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম ও সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সরকারের আর্থিক পদক্ষেপগুলো (ফিসক্যাল স্পেস) বাড়ানোর চিন্তা করতে হবে। বিশেষ করে কৃষি খাত ও রপ্তানি খাতে এ ধরনের পদক্ষেপ জরুরি। তিনি বলেন, আমরা জানি সারের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এখন যেভাবে দাম বেড়েছে, তাতে ২২ হাজার থেকে ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো প্রয়োজন হবে। এটি কীভাবে সমন্বয় করবে সরকার? আবার গ্যাসের দামও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে যে মাত্রায় রাজস্ব আহরণ হচ্ছে, তা দিয়ে মূল্য সমন্বয় করে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে।

বৈদেশিক সহায়তার বিষয়ে তিনি বলেন, বিদেশি বড় অর্থায়ন আসছে, এটা সত্য। তবে এটা কিন্তু বাজেট সহায়তা হিসেবে আসছে না, প্রকল্প সহায়তা হিসেবে আসছে। তাই এ অর্থ দিয়ে কৃষি ভর্তুকি বা অন্যান্য ফিসক্যাল স্পেস বাড়ানোর সুযোগ নেই। এজন্য আমাদের মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নিলে হবে না। সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করতে হবে।

রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা দেখছি রপ্তানি খাতে বিশেষ করে পোশাকশিল্পে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু টাকার মান হ্রাস পাওয়া ও আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের পোশাক উদ্যোক্তাদের মুনাফার মার্জিন খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। এখন মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে কিছুটা হলেও মনোযোগ দেয়া উচিত।

ফাহমিদা খাতুন তার উপস্থাপনায় সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বিষয়ে বলেন, রাজস্ব আহরণে গতবারের তুলনায় এবারের অর্জন ভালো। কিন্তু যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি অর্জন করা চ্যালেঞ্জিং হবে। প্রতিবছরই এমন এক লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়, যেটি রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হয়নি।

মূল প্রবন্ধে তিনি আরও বলেন, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি জীবনযাত্রার মানের ওপর নেতিবাচক ফেলেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে পণ্যের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেটা একটি বিষয়; আরেকটি বিষয় হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থায় সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক সময় সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকা সত্ত্বেও কারসাজি করে একটি মহল দাম বাড়িয়ে দেয়।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশে প্রকৃতপক্ষে চালের চাহিদা কত, তা পুনর্নির্ধারণ হওয়া প্রয়োজন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেবল খানা পর্যায়ে চালের ভোগ হিসাব করলে চলবে না। এখন পশুখাদ্য উৎপাদনসহ নানা ধরনের শিল্প উৎপাদনে চালের ব্যবহার রয়েছে। সব ধরনের চাহিদা যুক্ত করে দেশে চালের প্রকৃত চাহিদা নির্ণয় করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ উৎপাদের প্রকৃত অঙ্ক জানার বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে।

পুঁজিবাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে যাতে কোনো মহল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সে বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য কারা দায়ী সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বেশকিছু প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী ও ব্যক্তিপর্যায়ের কিছু বড় বিনিয়োগকারী অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে এ ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে বলেও সিপিডি জানায়।

সাধারণত এ ধরনের পর্যালোচনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির একটি প্রাক্কলন দেয় সিপিডি। কিন্তু এবার তা দেয়া হয়নি। প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন না দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, এখন প্রবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের কাছে খুব জরুরি বিষয় নয়। করোনার কারণে অর্থনীতি যে ধাক্কা খেয়েছে, তা থেকে পুনরুদ্ধার কতটা হচ্ছে, সেটিই মুখ্য বিষয়। তাছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সামাজিক সূচকে উত্তরণ কতটা জোরদার হচ্ছে, সে বিষয়েই আমাদের দৃষ্টি বেশি নিবদ্ধ।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০