কাজী সালমা সুলতানা: করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে যখন সারা বিশ্ব বিপর্যস্ত, তখন একটি দেশ সগৌরবে এগিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধজয়ের পথে। হয়তো কিছুদিন পর তারা বলতে পারবে, ‘হ্যাঁ, আমরা জিতেছি। আমরা মার্কিন যুদ্ধবিমান, যুদ্ধজাহাজ বা কথিত দুর্ধর্ষ সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও জিতেছিলাম। আমার জন্মেছি সব প্রতিরোধযোগ্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধেজয়ের জন্য।’ সেই দেশটি হলো ভিয়েতনাম। মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জেতার পর একটা বই পড়েছিলাম ‘অবাক নাম ভিয়েতনাম’। আজও সারা বিশ্ব অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ভিয়েতনামের দিকে।
করোনাভাইরাস চীনের উহানে দেখা দেয় গত বছর ডিসেম্বর মাসের প্রথমে। তখন অনেকেই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। উন্নত দেশগুলো ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় নিয়ে ভাবনার চেয়ে চীনকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত ছিল। করোনা প্রতিরোধে উহান বা চীনের কর্মকৌশল নিয়ে সমালোচনায় মুখর ছিল। আর সেই সময় অর্থাৎ চলতি বছরের জানুয়ারির শেষে টেট নববর্ষ উদযাপনকালে ভিয়েতনাম সরকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। অথচ তখনও ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব চীনেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী এনগুয়েন জুয়ান ফুক বলেন, ‘খুব দ্রুতই এই ভাইরাস এখানে এসে পড়বে। এই সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করা মানে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা।’ এভাবেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ভিয়েতনাম।

চীনের নিকট প্রতিবেশী জনবহুল দেশ ভিয়েতনাম। চীনের সঙ্গে রয়েছে এক হাজার ১০০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত এবং যোগাযোগও সহজ। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে বিরাট ব্যবসা-বাণিজ্য ও অনেক ধরনের সম্পর্ক। তার পরও দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনা-আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৬৮ (২৩ এপ্রিল পর্যন্ত)। আর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা শূন্য। চীন থেকে শুরু হয়ে ইউরোপের ধনী দেশগুলোতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেছে। অথচ ভিয়েতনামে তেমন কিছু হয়নি। যখন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে চলছে মৃত্যুর মিছিল, তখন ভিয়েতনামের এ চিত্র চমকে ওঠার মতোই। অবাক হওয়ার বিষয় তো অবশ্যই। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, কীভাবে অর্জিত হলো এ সাফল্য। ভিয়েতনাম কোভিড-১৯ ঠেকাচ্ছে কী করে?
ভিয়েতনামের স্বাস্থ্যসেবায় ইউরোপের মতো উন্নতমানের চিকিৎসার তকমা লাগেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো লাখ লাখ পরীক্ষা করার সাধ্য নেই তাদের। তবে ভিয়েতনামের রয়েছে সুষম স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামো। লোয় জেলায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক হাসপাতাল। জনপ্রতিনিধিরাও দেশের স্বাস্থ্যসেবার সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সজাগ। এ কারণে করোনা চীনে প্রাদুর্ভাবকালে হো চি মিন শহরের মেয়র জানিয়েছিলেন, তার শহরের ৮০ লাখ মানুষের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার বেড আছে মাত্র ৯০০টি। এ শহরে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে সহজেই তা সামর্থ্যকে অতিক্রম করবে।

করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে গোটা বিশ্ব যখন নাজেহাল, তখন ভিয়েতনামের সাফল্যের পেছনে রয়েছে সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা। চীন যখন লকডাউন ঘোষণা করেনি, তখন থেকেই বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করে ভিয়েতনাম। কোনোভাবেই গা-ছাড়া মনোভাব দেখায়নি দেশটি। সরকারি নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জনবহুল জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সন্দেহজনক সবাইকে খুঁজে খুঁজে পরীক্ষা করা শুরু হয়।
পরীক্ষার জন্য ভিয়েতনাম একটা সহজ ও কম খরচের কিটও বানিয়ে ফেলে। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কোয়ারেন্টাইন কৌশলকে প্রাধান্য দিয়েছে ভিয়েতনাম। খুব কড়াকড়িভাবে এ কাজটি করেছে দেশটি। একইসঙ্গে ভাইরাস-আক্রান্ত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসা সবাইকে খুঁজে বের করেছে।
জানুয়ারিতেই প্রথম করোনা রোগীর খোঁজ পাওয়া যায় ভিয়েতনামে। তাই এত সতর্কতার পরও আত্মতুষ্টিতে নেই, নেই সতর্কতার বিন্দুমাত্র শৈথিল্য। ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তিন সপ্তাহের জন্য হ্যানয়ের পাশে ১০ হাজার অধিবাসীর একটি শহর সম্পূর্ণ আলাদা করে ফেলে তারা। সে সময় পুরো দেশে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন মাত্র ১০ জন। শুরু থেকেই উচ্চ ঝুঁকির দেশ থেকে যারাই ভিয়েতনামে এসেছেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে সব স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা হয়েছে।
গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ভিয়েতনাম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করে। দেশের সব বিমানবন্দরে যাত্রীদের কঠোর স্বাস্থ্য পরীক্ষা চালু করা হয়। বিমানবন্দরে আগত যাত্রীদের শরীরের তাপমাত্রা মাপা এবং স্বাস্থ্যফর্ম পূরণ বাধ্যতামূলক করা হয়। সেই ফর্মে উল্লেখ করতে হয়, ওই যাত্রী কোথায় কোথায় গিয়েছিল এবং কার কার সংস্পর্শে ছিল।
এখনও দেশটিতে এ ধরনের কঠোর ব্যবস্থা চালু আছে। যেকোনো বড় শহরে ঢুকতে বা সেখান থেকে বের হতে হলে এসব তথ্য জানাতে হয়। কোনো সরকারি দপ্তরে বা হাসপাতালে ঢুকতে গেলেও এসব তথ্য দিতে হয়। কারও শরীরের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে থাকলেই তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় অধিকতর পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য।
স্বাস্থ্যফর্মে ভুল তথ্য দিলে তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি করোনা-আক্রান্ত দেশ থেকে ভিয়েতনামে এলেই তাদের ওপর নজরদারি চালানো হয়। তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের ওপরও চলে নজরদারি। চ‚ড়ান্তভাবে তাদের কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়। নজরদারি এড়িয়ে কেউ বেরিয়ে যেতে পারে না।
মার্চ মাসে এক প্রতিষ্ঠিত নারী ব্যবসায়ী ইউরোপ থেকে জ্বর ও কাশি নিয়ে দেশে আসে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণ ফাঁকি দিয়ে ওই নারী ঢুকে পড়ে দেশে, কিন্তু ঠিকই খবর পেয়ে যায় পুলিশ বিভাগ। তিন দিনের মধ্যে খুঁজে বের করে ওই নারী ব্যবসায়ীকে। সেই সঙ্গে ওই বিমানে অন্য যাত্রীদেরও খুঁজে বের করা হয় ইমিগ্রেশনের সহায়তায়। একইসঙ্গে এই তিন দিনে ওই নারী কোথায় কোথায় গেছেন, কার কার সংস্পর্শে গেছেন সবাইকে শনাক্ত করা হয়। সবাইকে নিয়ে আসা হয় কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। পরে দেখা যায়, ওই বিমানের যাত্রী ও তার সংস্পর্শে আসা ১৪৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত।
ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে দেশটির যেসব নাগরিক বিদেশ থেকে ফিরেছে, তাদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকা এবং কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়েছে। ভিয়েতনামে আসা বিদেশিদের বেলায়ও একই নীতি অনুসরণ করা হয়। দেশের ভেতরেও একটি বড় নগরী থেকে আরেকটি বড় নগরীতে যাওয়ার ক্ষেত্রে একই ধরনের কোয়ারেন্টাইন নীতি চালু করা হয়। কোনো শহরের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে ওই শহরে ঢোকার ক্ষেত্রে ১৪ দিনের জন্য কোয়ারেন্টাইনে থাকা বাধ্যতামূলক।
এই কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থাপনা করে সরকার এবং খরচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। এখানেই থেমে থাকেনি ভিয়েতনাম। এসব ক্ষেত্রে প্রশাসন বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হয়। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্রের একটি দায়িত্ব থাকে সুষ্ঠুভাবে কাজ সম্পাদন করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা। জনগণের চেতনার জায়গাটি শানিত করা। সেই কাজটিও করেছে ভিয়েতনাম অত্যন্ত কার্যকরভাইে।
শুরু থেকেই সরকার এই করোনাভাইরাস কতটা মারাত্মক এবং কতটা বিপর্যায় বয়ে আনতে পারে, সে বিষয়ে জনগণকে বার্তা দিয়েছে। জনগণকে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সেই বার্তাটির ভেতরে কোনো ধরনের তাচ্ছিল্য ছিল না। জনগণকে জানানো হয়েছে, এটি কোনো সাধারণ ফ্লু নয়, বরং মারাত্মক ধরনের ভাইরাস। তাই কেউ যেন কোনোভাবেই নিজেকে ঝুঁকিতে না ফেলে। করোনাভাইরাস সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে একটি সৃজনশীল কৌশলও গ্রহণ করে ভিয়েতনাম।
প্রতিদিন দেশটির প্রধানমন্ত্রী থেকে তথ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সব মানুষের মোবাইল ফোনে করোনাভাইরাসের ব্যাপারে তথ্য দিয়ে টেক্সট পাঠানো হতো। এর পাশাপাশি সরকারি প্রচারণা তো আছেই। ভিয়েতনামের সব শহরে পোস্টার লাগানো হয়েছে এ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জনগণকে তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে।
অনেকেই বলতে পারেন, একটি কমিউনিস্ট আদর্শের দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম এই কঠোরতা আরোপ করতে পেরেছে। তা হলে প্রশ্ন করতেই হয় রাজনৈতিক আদর্শ কি মানুষের কল্যাণের জন্য নয়, মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য নয়? মানুষের জীবন বড়, নাকি কথা বলা বা চলাচলের স্বাধীনতা বড়? যে স্বাধীনতা অন্যের জীবনকেও বিপন্ন করে তোলে, তাকে কি স্বাধীনতা বলা যায়?
যে রাজনৈতিক আদর্শ মানুষের জীবন রক্ষার কৌশল প্রয়োগ করতে পারে না, সেই রাজনৈতিক আদর্শের প্রয়োজনটা কোথায়? যে রাষ্ট্রীয় আদর্শ মানুষের জীবন রক্ষা করতে পারে না, সেই আদর্শ অবশ্যই রাষ্ট্রের জন্য উপযোগী নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় সেই আদর্শ প্রযোজ্য হতে পারে না।
জার্মানির মতো পশ্চিমা দেশগুলোও এখনও করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তি ও তাদের সরাসরি সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খোঁজ করছে। অথচ ভিয়েতনাম করোনা-আক্রান্ত ব্যক্তিকে সরাসরি এবং দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্যায়ের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদেরও খোঁজ রেখেছে। তাদের সবার চলাফেরায় আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। শুধু ওষুধ ও স্বাস্থ্য প্রযুক্তির সহায়তায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকানোর চেষ্টা করেনি ভিয়েতনাম। তার পরিবর্তে তাদের সবার আস্থাভাজন সেনাবাহিনীর উচ্চমানের প্রযুক্তির নজরদারি সেবা কাজে লাগিয়েছে। দেশের প্রত্যেক সড়ক ও ক্রসিংয়ে অথবা গ্রামে মোতায়েন করা হয়েছে নিরাপত্তা কর্মকর্তা বা কমিউনিস্ট পার্টির গোয়েন্দাদের। নিবিড় পর্যবেক্ষণের কারণে নিয়ম না মানা খুব দুঃসাধ্য সেখানে।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সাফল্য অর্জন করেছে ভিয়েতনাম। এখন তারা গোটা ইউরোপের পাশে দাঁড়িয়েছে। করোনায় আক্রান্ত ইউরোপের দেশগুলোর জন্য সাড়ে পাঁচ লাখ মাস্ক পাঠাচ্ছে তারা। ইতালি, স্পেন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানির দূতদের হাতে এই মাস্ক তুলে দেওয়া হয়েছে এরই মধ্যে। ভিয়েতনামের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছে। এ কারণেই ৮৮ বছর বয়সি বৃদ্ধাও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ভিয়েতনামে। কাজেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিয়েতনাম প্রতিটি দেশের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত।
গণমাধ্যমকর্মী