ইসমাইল আলী: করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার আগেই বন্যা আঘাত হানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এতে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার মধ্যে অন্যতম পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্প। এ দুইয়ের প্রভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে যশোর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটির কাজ। ফলে একই দিনে পদ্মা সেতুতে যানবাহন ও ট্রেন চালু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সম্প্রতি রেল ভবনে অনুষ্ঠিত ফাস্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, চীনে নববর্ষ উদযাপনে গিয়ে করোনার জন্য আটকে গেছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় নির্মাণসামগ্রী ও শিপমেন্ট বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। এছাড়া প্রকল্পটির কাজ শুরু থেকে আট মাস পিছিয়ে ছিল। আবার নকশা পরিবর্তনের জন্য বিভিন্ন অংশের কাজ বিলম্বিত হয়েছে। এতে আরেক দফা বাড়বে প্রকল্পের ব্যয় ও বাস্তবায়নের মেয়াদ।
এদিকে প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের জন্য প্রয়োজনীয় জমি বুঝিয়ে দিতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে নির্মাণকাজ বিলম্বিত হওয়ায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন (সিআরইসি)।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ. চৌধুরী বৈঠকে জানান, ‘প্রকল্পে প্রায় ৯০০ জন চীনা নাগরিক বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন। চায়নিজ নববর্ষ পালন উপলক্ষে প্রায় ২৫০ জন জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে চীনে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে উহান ছাড়া অন্য প্রদেশে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সুস্থ প্রায় ১০০ জন সিআরইসি’র নিয়মাবলি মেনে চীনে ১৪ দিন ও বাংলাদেশে ১৪ দিন মিলে মোট ২৮ দিন হোম কোয়ারেন্টাইন শেষে ফেব্রুয়ারির শেষভাগে কাজে যোগদান করেন। তবে ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারিং, বক্স গার্ডার ইরেকশন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, ব্যালাস্টলেস ট্র্যাক ডিজাইন ও নির্মাণসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং কংক্রিট সিøপার স্থাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনবলের বেশিরভাগ চীনে আটকা পড়েছেন। এর ফলে অন্যান্য কাজের ডিজাইনসহ পদ্মা সেতু ও দু’পাশের ভায়াডাক্টে ব্যালাস্টলেস রেলপথ নির্মাণের বিশদ ডিজাইন, কর্মপদ্ধতি ও মাননিয়ন্ত্রক পদ্ধতি চূড়ান্তকরত নির্মাণকাজ সম্পাদন এবং ভাঙাতে কংক্রিট সিøপার নির্মাণ ফ্যাক্টরি চালু করাতে বিলম্ব হচ্ছে।’
বৈঠকে আরও জানানো হয়, জুনের মধ্যে চীন থেকে ভাঙ্গা-মাওয়া অগ্রাধিকার সেকশনের জন্য রেল, ফিটিংস, পয়েন্টস অ্যান্ড ক্রসিং, ব্রিজের গার্ডার ইত্যাদি পৌঁছার কথা থাকলেও করোনার মহামারির কারণে শিপিং বন্ধ ছিল এবং চীনে কিছু মালামালের উৎপাদন বন্ধ ছিল। ফলে শিডিউল মোতাবেক মালামালগুলো পৌঁছায়নি এবং নির্মাণকাজ কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী সম্পাদিত হবে না। এতে কাজের মেয়াদ বৃদ্ধি পাবে ও ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রকল্পের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি পেলে পরামর্শক ও ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বৃদ্ধি পাবে।
এদিকে সম্প্রতি দেশের বেশকিছু জেলায় বন্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট জেলা যথা মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, যশোর, নড়াইল ও গোপালগঞ্জ জেলাগুলো বন্যায় প্লাবিত হওয়ায় প্রকল্পের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। আর করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক বন্যায় নির্মাণকাজ পিছিয়ে যাওয়ায় চুক্তির শর্তানুসারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সময় বৃদ্ধি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে।
জমি অধিগ্রহণ নিয়েও জটিলতা রয়েছে বলে বৈঠকে জানানো হয়। এক্ষেত্রে জানানো হয়, বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃক বিভিন্ন নদীতে ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স বৃদ্ধি, এলজিইডি কর্তৃক আন্ডারপাসের ভার্টিকাল ক্লিয়ারেন্স বৃদ্ধি, জনগণের দাবিতে নতুন নতুন কালভার্ট ও আন্ডারপাস নির্মাণ, সিআরইসির ডিজাইন পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে করোনা মহামারি ও বন্যার কারণে বিভিন্ন জেলায় মাঠ পর্যায়ে সার্ভে বা যৌথ তদন্ত কাজ ব্যাহত হয়। ওই জমি বুঝিয়ে দিতে বিলম্বের কারণে চুক্তির শর্তানুসারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজের সময় বৃদ্ধি ও ক্ষতিপূরণ দাবি করে নোটিস দিয়েছে।
এদিকে প্রকল্পের অগ্রগতি অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে নিয়মিত ঠিকাদারের পাওনা পরিশোধ এবং ডিজাইন রিভিউ ও ভৌত অগ্রগতি দ্রুততর করার জন্য চুক্তিপত্রের পিসিসি ও পেমেন্ট শিডিউল সংশোধনের জন্য সাপ্লিমেন্টারি চুক্তি-২ অনুমোদনের প্রক্রিয়াকরণ করা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু তা অনুমোদন না হওয়ায় প্রকল্পের গতি স্থবির হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই দিনে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চালু করা সম্ভব নাও হতে পারে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ. চৌধুরী এ প্রসঙ্গে জানান, ‘ডিজাইন চূড়ান্তকরণের জটিলতার কারণে মাওয়া-ভাঙ্গা অগ্রাধিকার সেকশনের কাজ আগেই আট মাস পিছিয়ে ছিল, যা কর্মপরিকল্পনা সংকুচিত করে কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক বন্যার কারণে এ সেকশনের নির্মাণকাজ বন্ধ না হলেও অগ্রগতি ধীর হয়ে গেছে। ফলে এ সেকশনের কাজ যথাসময়ে সমাপ্ত করে পদ্মা সেতুতে ডে-ওয়ানে রেল চালু করার পরিকল্পনাটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে পদ্মা রেল সেতু সংযোগ প্রকল্পটি অনুমোদন করা হয়। সে সময় ২০২২ সালের জুনে এর কাজ শেষ করার লক্ষ্য ধরা হয়েছিল। পরে তা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের জুন করা হয়েছে। তবে এ মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো দরকার হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে প্রকল্পের মেয়াদের পাশাপাশি এর ব্যয়ও এক দফা বেড়েছে। এক্ষেত্রে ২০১৬ সালে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়ে গেছে চার হাজার ২৫৭ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির ব্যয় আরেক দফা ব্যয় বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে অনুমোদন ছাড়াই ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা ব্যয় করতে চায় রেলওয়ে। এর মধ্যে ৬৪০ একর অতিরিক্ত ভূমি অধিগ্রহণে দরকার হবে ৯৪০ কোটি টাকা। এছাড়া ইউটিলিটি শিফটিং বাবদ অতিরিক্ত ২৫২ কোটি টাকা ও তৃতীয় পক্ষ পরামর্শক বাবদ আরও ২ কোটি টাকা দরকার হবে। রেলপথটি নির্মাণের শেষদিকে এসব ব্যয় সমন্বয় করা হবে।