Print Date & Time : 21 June 2025 Saturday 3:47 am

করোনা ভ্যাকসিন ও বিশ্ব রাজনীতি

জসীম উদ্দিন : বর্তমানে বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্ক ও সমস্যার নাম করোনা প্যানডেমিক। কভিডের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের সবকিছু আজ স্তব্ধ, নীরব, নিস্তেজ। ফলে ইতোমধ্যে খবর মিলেছে এমন নাজেহাল পরিস্থিতি সামাল না দিতে পেরে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে অনেক সরকারি ব্যক্তিরা বেছে নিয়েছেন আত্মহত্যা বা পদত্যাগের পথ। তাছাড়া সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, করোনা মহামারির জন্য পৃথিবীতে ১০ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে আসবে। তবে কিছু কিছু দেশের কথা না বললেই নয় যে দেশগুলোর মানুষ সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর শিকার হয়েছে যেমন ইতালি, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন প্রভৃতি।

শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো যেখানে এমন নাজেহাল পরিস্থিতি সামাল দিতে চরম হিমশিম খাচ্ছে সেখানে পৃথিবীর অন্য উন্নয়নশীল বা দুর্বল রাষ্ট্রগুলো কতটা দুর্ভোগে আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। ফলে বোঝাই যাচ্ছে একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন/টিকা বর্তমান সময়ে কতটা আশার আলো!

আশার আলো কে কার আগে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেবে, তা নিয়ে চলছে বিশ্ব রাজনীতি। অর্থাৎ বর্তমানে চলছে নয়া এক টিকাযুদ্ধ। ওষুধ কোম্পানি, গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকারি মহলও একটি কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পেছনে বিনিয়োগ করছে বিলিয়ন বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

এখন পর্যন্ত ২০২টি ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে। যার মধ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে ২৭টি এবং ট্রায়ালের তৃতীয় পর্যায়ে আছে সাতটি ভ্যাকসিন; যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন, যুক্তরাষ্ট্রের মার্ডানার ভ্যাকসিন, চীনের সিনোভ্যাকের ভ্যাকসিন, অস্ট্রেলিয়ার মারডক চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন ও রাশিয়ার গ্যামিলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিন।

সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে রাশিয়ার তৈরিকৃত ভ্যাকসিন। রাশিয়া গত ১১ আগস্ট তাদের তৈরিকৃত ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’ বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিন হিসেবে অনুমোদন দেয়। তবে তা মেনে নিতে নারাজ পোষণ করছে পশ্চিমা বিশ্বের শক্তিশালী পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো। অনেক বিজ্ঞানী যারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা করছেন তারা বলেছেন, রাশিয়া তাদের তৈরিকৃত ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (পাবলিক) ছাড়াই অনুমোদন দিয়েছে। তাই তারা এ ভ্যাকসিনকে ততটা কার্যকরী বলে মনে করছেন না।

ইতোমধ্যে ভ্লাদিমির পুতিন গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন যে, প্রথমেই তার দুই মেয়ের শরীরে ট্রায়াল দিয়ে, সুফল পেয়েই এ ভ্যাকসিনকে অনুমোদন দিয়েছে। এবং আরও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, এ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে ৪০ হাজার সেচ্ছাসেবী শরীরে ট্রায়াল দেবে। তারপরেই তারা অক্টোবরে এ ভ্যাকসিন সবার জন্য উš§ুক্ত করবে। রাশিয়ার তৈরিকৃত ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’ নাম হওয়ায় কিন্তু রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৫৭ সালে রাশিয়া মহাকাশে যে নভোযান পাঠাতে চেয়েছিল তার নাম ছিল স্পুটনিক-১। সেটি চরম ব্যর্থতার পর্যবসিত হয়েছিল। আর রাশিয়ার এ ব্যর্থতার দিনে অনেক রাষ্ট্র মজা লুটেছিল। যার পাল্টা জবাব রাশিয়া তখন যথাযথ দিতে পারেনি। সেই জবাব দিতেই কি রাশিয়া এই নাম ব্যবহার করেছে, নাকি অন্য কিছু?

রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে ইতোমধ্যে ডব্লিউএইচও আলোচনা শুরু করেছে। তাছাড়া অনেক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রও রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে (চীন, কিউবা, ফিলিপাইন, দক্ষিণ কোরিয়া)। তবে কেন এত সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে তা এখনও সবার অজানা। তবে আমি মনে করি এ রকম সমর্থন দিয়ে যাওয়ার পেছনে সূক্ষ্ম একটি কারণ রয়েছে আর তা হলো, যাতে বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো এক নেতৃত্বদানের পথ সৃষ্টি করতে পারে। তবে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এখনও রাশিয়ার তৈরিকৃত ভ্যাকসিন সম্পর্কে কোনো রকম নেতিবাচক মত পোষণ করেননি। তিনি এই ভ্যাকসিন নিয়ে কিছুটা ইতিবাচক আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে আমেরিকার অনেক বিজ্ঞানী যেখানে এ ভ্যাকসিন নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্প কেন নীরব বা ইতিবাচক মনোভাব তা আজ সময়ের প্রশ্ন। সত্যি বলতে এখানে কি আগামী ৩ নভেম্বরের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের (যুক্তরাষ্ট্র) স্বার্থ লুকিয়ে আছে? তা কিন্তু হতেও পারে।

অন্যদিকে চীনের ভ্যাকসিন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব একেবারে নেতিবাচক। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে উসকানি দিয়ে করোনাভাইরাসকে আখ্যায়িত করেছেন চাইনিজ ভাইরাস”নামে যেটি চূড়ান্ত রকমের বর্ণবাদী আচরণ হিসেবে সমালোচিত হয়েছে পুরো বিশ্বে। মানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রথম থেকে যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাকযুদ্ধে জড়িত। এরই মধ্যে যদি দু’দেশের মধ্যে এক দেশ করোনার কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেই ফেলে তাহলে জাতীয়তাবাদী চেতনা অক্ষুন্ন থাকারই বেশি সন্দিহান বোধ করছি। তারই প্রেক্ষিতে তখন পৃথিবীব্যাপী বৈষম্যের চিত্র চরমভাবেই ফুটে উঠতে পারে। এমনকি এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রগুলো আরও দুর্ভোগের শিকার হতে পারে।

রাশিয়ার তৈরিকৃত ভ্যাকসিন চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হলেও পরবর্তী বিশ্ব কেমন হবে, তা বলা মুশকিল। তবে মনে করি যদি তা হয় তাহলে আবারও সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদ মাথা নাড়া দিয়ে উঠবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেমন স্নায়ুযুদ্ধ সংগঠিত হয়ে বিশ্ব দুই মেরুতে বিভক্ত হয়েছিল তেমনই তা আবার নতুন রূপে শুরু হওয়ার আভাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে মানে নেতৃত্ব স্থানান্তরিত হওয়ার আভাস। ইতোমধ্যে ডানপন্থি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলো (আমেরিকা) তাদের ফার্মাসিউটিক্যাল ফার্মকে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে ব্যাপক চাপ দিচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, চীন, রাশিয়াও এক হয়ে গোপনে কাজ করছে।

যুদ্ধটা তখনি শুরু হবে যখন রাশিয়া আমেরিকাকে ভ্যাকসিন দিতে নাচক করবে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিশ্চিত করেছেন, যে রাষ্ট্র আমাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহণ করবে তারা ভ্যাকসিন কার্যকরী হলে, ভ্যাকসিন পেতে বেশি অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু মজার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এখনও পুতিনের এ কথার বহির্ভূত সীমানায়। তাছাড়া ভ্যাকসিন প্রসঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখালেও রাশিয়া কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এখনও নীরব। তবে আমেরিকার প্রতি রাশিয়া যতটা নীরব ততটাই কিন্তু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র; চীনের প্রতি নীরব না। মানে রাশিয়া ভ্যাকসিন কার্যকর করতে পারলে চীনকে বেশি অগ্রাধিকার দিবে আর চীন করতে পারলে রাশিয়াকে দেবে। তবে এখানে কিন্তু আমেরিকা ফাঁকে পড়ে যাচ্ছে, যা স্নায়ুযুদ্ধের বড় ইঙ্গিত।

করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি হলে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো চরম দুর্ভোগে পড়বে। এ পর্যন্ত বিশ্বে যত ধরনের যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে তাতে অক্ষশক্তি ও মিত্র শক্তি যতটা না ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তার থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তৃতীয় পক্ষ। এবারও যদি সে রকম কিছু একটা ঘটে তাতে জনসাধারণ বা তৃতীয় পক্ষই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে। তবে ডব্লিউএইচও এ রাজনীতি থামাতে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তা আজ ভাববার বিষয়। ডব্লিউএইচও ইতোমধ্যে ৯০টি রাষ্ট্রকে নির্বাচন করেছে যারা কার্যকরী ভ্যাকসিন পেতে বেশি অগ্রাধিকার পাবে। কিন্তু এ লিস্ট কার্যকরী ভ্যাকসিন আসার পর কতটা কার্যকর হবে তা বলাবাহুল্য।

করোনা ভ্যাকসিন এখনও চূড়ান্ত না হওয়ার আগেই যেখানে রাজনৈতিক সুরাহা টানাটানি হচ্ছে ভ্যাকসিন পাওয়ার পর কেমন রূপ নেবে তা ইতোমধ্যে সবারই দৃষ্টিগোচর করে। সুতরাং আজ নিরপেক্ষ মানুষগুলোর মনে একটাই প্রশ্ন, যদি এমনটাই হয় তাহলে আট বিলিয়ন মানুষের কি হবে? ৮০০ কোটি মানুষের স্বার্থে অক্ষশক্তি ও পরাশক্তি কারোই করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে রাজনীতি না করা উচিত। তাহলেই করোনা ভ্যাকসিন পাওয়ার পর দ্রুততর সঙ্গে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে পুরো বিশ্ব।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়