নিজস্ব প্রতিবেদক: করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে সামাজিক অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। এজন্য যতদিন টিকা পাওয়া না যায়, ততদিন মাস্ক পরার অভ্যাস করতে হবে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্কের বিকল্প নেই। সবাইকে মাস্ক পরাতে হলে এটিকে সামাজিক রীতিতে রূপ দিতে হবে। সেজন্য জনপ্রতিনিধি ও ইমামদের কাজে লাগাতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) আয়োজিত ওয়েবিনার আলোচনা সভায় গবেষক ও অর্থনীতিবিদেরা এসব কথা বলেন। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের কাছে এ মুহূর্তে মাস্ক গুরুত্বপূর্ণ নয়, কারণ মানুষ মাস্ক পরতে চায় না। এছাড়া মানুষের কাছে বিনা পয়সায় মাস্ক পৌঁছে দিতে অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হবে। সরকার মাস্কের চেয়ে এখন টিকার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেনের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুশফিক মোবারক ও ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। আলোচনায় বক্তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নানা অনিয়ম ও অদক্ষতার সমালোচনা করেন।
আসিফ সালেহ বলেন, করোনা ঠেকাতে বিধিনিষেধ বা লকডাউন দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ পদ্ধতি কার্যকর নয়, বরং অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মাস্ক কার্যকর ভূমিকা রাখছে বলে তাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ব্র্যাক এরই মধ্যে সাত কোটি ৭০ লাখ মানুষের কাছে বিনা পয়সায় সার্জিক্যাল মাস্ক পৌঁছে দিয়েছে। এ কাজে আরও প্রয়োজন সাড়ে পাঁচ কোটি সার্জিক্যাল মাস্ক, যা তৈরিতে খরচ পড়বে ২৫ কোটি টাকা। এ টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী ও দেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে চাওয়া হলেও পাওয়া যায়নি। তার মতে, করোনার বিস্তৃতি ঠেকাতে কমিউনিটি ছাড়া সম্ভব নয়। এজন্য সামাজিক দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। করোনা প্রতিরোধে সামাজিক অংশগ্রহণের বিকল্প নেই।
মুশফিক মোবারক বলেন, এক লাখ ৩০ হাজার খানার ওপর করা জরিপে দেখা গেছে, প্রচারকের মাধ্যমে মাস্ক ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করার ফলে মাস্কের ব্যবহার ২৯ শতাংশ হারে বাড়ে, যা ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত টেকসই হয়। বিনা পয়সায় মাস্ক বিতরণে জনপ্রতিনিধি, মসজিদের ইমাম ও প্রচারকের সহযোগিতা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
মসিউর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম নিয়ে কথা হচ্ছে। অনেকে এসব অনিয়মের সঙ্গে মন্ত্রীর সম্পৃক্ততার কথা বলছেন, কিন্তু মন্ত্রীর পাশাপাশি সেখানে অন্যদেরও দায়িত্ব থাকে। তিনি বলেন, মাস্ক এখন রক্ষা করবে। কিন্তু টিকার বিকল্প মাস্ক নয়।
আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, আমাদের দেশে বড় সমস্যা হচ্ছে মানুষের আচরণ। গ্রামের মানুষ ভাবে এটা শহরের রোগ, আবার শ্রমজীবীরা ভাবে এটা বড় লোকদের রোগ, যারা এসিতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে করোনাভাইরাস কাউকেই ছাড়ছে না। গ্রামের মানুষকে মাস্ক পরতে দেখা যায় না। অভিযান পরিচালনা করে, বল প্রয়োগ করে এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও মানুষকে মাস্ক পরানো যায়নি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যেখানে-সেখানে মাস্ক পড়ে থাকে। এতে পরিবেশের ক্ষতি হয়।
মাস্ক বিনা পয়সায় দেয়া নিয়ে তিনি বলেন, মাস্ক বিনা পয়সায় দেয়া হবে। কিন্তু বিতরণ করবে কে? বিতরণ করতে গিয়ে ১০ টাকা করে খরচ হবে। তাই মাস্কের পরিবর্তে সরকার টিকার দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। সব জায়গা থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। সরকারের অগ্রাধিকার এখন টিকায়, মাস্কে নয়। তবে মাস্ক কিনতে যে ২৫ কোটি টাকার কথা বলা হয়েছে, সেটি কোনো টাকাই নয়। এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য খাতে টাকা কোনো সমস্যা নয়, চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বিতরণ ও ব্যবস্থাপনা। কভিডের সময়েও স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে যা টাকা চাওয়া হয়েছে, তা-ই দেয়া হয়েছে। অন্য ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন করেও টাকা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে দেখা যাবে, যা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তার সব খরচ করা যায়নি।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, করোনা প্রতিরোধে স্বল্প, মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। যে যার মতো করে সুপারিশ দিলে হবে না, নীতিনির্ধারকদের ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত।
ড. আতিউর রহমান বলেন, মাস্ক ব্যবহারের কারণে যে পোশাক খাতে বড় পরিবর্তন এসেছে, সেটি একটি উদাহরণ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
বিনায়ক সেন বলেন, সীমান্ত এলাকায় মৃত্যু ও সংক্রমণ দুটোই বাড়ছে। আগে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দিকে সবার নজর ছিল। এখন ঢাকায় সংক্রমণ কমেছে। দেশের অন্যান্য অঞ্চলে করোনা বাড়ছে। এজন্য করোনা সংক্রমিত অঞ্চলগুলো থেকে ঢাকায় গণপরিবহন পরিচালনা ঝুঁকির সৃষ্টি করেছে। মালামাল পরিবহন অব্যাহত রাখলেও গণপরিবহনে যারা ঢাকায় আসেন, তাদের বাধাহীন আসা বন্ধ করা উচিত।
আলোচনা সভায় জানানো হয়, দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামাঞ্চলেও এভাবে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে তাহলে যে বিপর্যয় দেখা দেবে, তা আমরা এখন যে পরিস্থিতি দেখছি, তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় গ্রামের বাসিন্দাদের হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার সুযোগ সীমিত। শহরবাসীর মতো তারা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সুযোগ এবং অক্সিজেন পাবে না। গ্রামের হাসপাতালগুলোর যে সক্ষমতা, এতে অল্প কয়েকজন রোগীতেই সেগুলো উপচে পড়বে। এছাড়া এসব এলাকায় ব্যাপকভাবে টিকাদান শুরু করতেও কয়েক মাস লেগে যাবে। তাই চলমান করোনা মহামারির নতুন ঢেউ সামাল দিতে মাস্ক পরার মতো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়াই এখন পর্যন্ত আমাদের সর্বোত্তম হাতিয়ার। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রচারকের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমিক মনিটরিং ও মাস্ক ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করার ফলে মাস্কের ব্যবহার ২৯ শতাংশ হারে বাড়ে, যা ১০ সপ্তাহ পর্যন্ত টেকসই হয়। ফলে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার হার পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মাস্ক পরার অভ্যাস ছড়িয়ে দিতে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।