নাজমুল হুসাইন: দেশে কর্নিয়াজনিত অন্ধ মানুষের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ। যা দেশের মোট অন্ধ মানুষের এক-তৃতীয়াংশ। দৃষ্টিজনিত সমস্যায় ভোগা এমন মানুষের ভরসার জায়গা তৈরি করতে পেরেছে সন্ধানী।
গত তিন দশক ধরে স্বেচ্ছাসেবী কর্নিয়া সংগ্রহকারী সংগঠন হিসেবেও কাজ করে যাচ্ছে সন্ধানী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় চার হাজার চোখ সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর সাড়ে তিন হাজার কর্নিয়া সংযোজন করে চোখে আলো ফিরিয়ে দিয়েছে।
মানব দেহে অনেক কৃত্রিম অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয়েছে। তবে কর্নিয়া সংযোজনের কোনো বিকল্প এখনও আবিষ্কার হয়নি। ফলে বিশ্বের সবখানে মরণোত্তর চক্ষুদানই কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব প্রতিরোধের একমাত্র উপায় বলে স্বীকৃত। চক্ষুদানের মাধ্যমে অন্ধত্ব দূর করতে ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি। তাদের পাশাপাশি মরণোত্তর চক্ষুদানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এ প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে ১৯৭৫ সালে ‘মরণোত্তর চক্ষুদান অধ্যাদেশ’ জারি করে বাংলাদেশ সরকার।
ভারতের আই ডিজিজেস স্টাডি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সন্ধানী বলছে, বাংলাদেশে অন্ধ ব্যক্তির সংখ্যা ১৪ লাখের বেশি। তাদের মধ্যে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্বের শিকার পাঁচ লাখ ২৬ হাজার। এর মধ্যে এক লাখ ৬০ হাজার মানুষের দুই চোখ কর্নিয়ার কারণে অন্ধ। আর তিন লাখ ৬৬ হাজার রোগীর এক চোখ অন্ধ।
বর্তমানে বছরে কর্নিয়া সংগ্রহের হার মাত্র ২০০ থেকে ২৫০টি। সন্ধানীতে গতকাল কর্নিয়ার খোঁজে এসেছিলেন মধ্যবয়স্ক নীলিমা বেগম (ছদ্ম নাম)। আবেদনপত্র পূরণের পরে তিনি বলেন, তার চোখের কর্নিয়া অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ন্যাশনাল আই ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার আবেদনের সিরিয়াল সাড়ে পাঁচ হাজারজনের পর। অবশ্য ডাক্তার তাকে শিগগিরই কর্নিয়া সংযোজন করতে বলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার এখন চোখের কর্নিয়া লাগবে। ওরা বলছে, দিতে পারবে কিনা তার ঠিক নেই। থাকলে পাবেন। আবেদন করুন।’ খোঁজ নেওয়ার জন্য কয়েক মাস পরপর ফোন দিতে বলেছে সন্ধানী কর্তৃপক্ষ।
সন্ধানী বলছে, প্রতি বছর ছয় হাজার আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা বছরে মাত্র দেড়শ থেকে ২০০ কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারছে। আবেদনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতেই তা বণ্টন করা হয়। বর্তমানে বছরে যে পরিমাণ কর্নিয়া সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে, তাতে কর্নিয়াজনিত অন্ধত্ব দূর করতে সাড়ে তিন হাজার বছর লেগে যাবে। সন্ধানীর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে অন্ধত্ব দূর করতে হলে প্রতি বছর সাড়ে তিন হাজার কর্নিয়া প্রয়োজন। সরকারি হিসাবে দেশে মৃত্যুহার ৭.৮ শতাংশ। প্রতিবছর দেশে ১১ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে। সেখান থেকে মাত্র এক দশমিক পাঁচ শতাংশ কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারলে কর্নিয়ার অভাব দূর করা সম্ভব। সন্ধানী বর্তমানে বেওয়ারিশ লাশনির্ভরতায় তাদের চক্ষু সংগ্রহের কাজ পরিচালনা করছে। তবে বর্তমানে বেওয়ারিশ লাশের সংখ্যাও কমে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ও সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির মহাসচিব ডা. একেএম সালেক বলেন, আমরা কর্নিয়া পাচ্ছি না। এ কারণেই দিতে পারছি না। কর্নিয়া সংগ্রহ ক্রমেই মন্থর হয়ে আসছে। তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবে দেশে চক্ষু সংগ্রহ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে চক্ষুদানকে ধর্মের পরিপন্থী ভাবছেন, যা সম্পূর্ণ ভুল। এছাড়া প্রচারের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। সমাজের সবাইকে এ উদ্যোগে এগিয়ে আসা উচিত।
দেশের প্রচলিত আইনে ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মরণোত্তর চক্ষুদান। অথচ চক্ষুদানে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। এ কারণে সন্ধানীর এ জাতীয় চক্ষুদান সমিতির আন্দোলন সফল হচ্ছে না। মরণোত্তর চক্ষুদানের অঙ্গীকারের তুলনায় কর্নিয়া সংগ্রহের হার কম। যেহেতু মৃত্যুর আট ঘণ্টার মধ্যেই এ কর্নিয়া সংগ্রহ করতে হয়, সেক্ষেত্রে কিছু বাধা তৈরি হচ্ছে। বিদেশে মৃত্যু হলে সে কর্নিয়া সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গীকারকারী মৃতের পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর খবর জানান না। কিছু ক্ষেত্রে তারা অসহযোগিতাও করছেন। সব মিলে থমকে আছে এ কর্নিয়া সংগ্রহ এমন মনে করেন সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কো-অর্ডিনেটর সাইফুল ইসলাম চৌধুরী।
Add Comment