কর্মকাণ্ড নিয়মবহির্ভূত হলেও প্রতারণা নয়

শামসুন নাহার: এল কে আদভানি ও অটল বিহারি বাজপেয়ির মতো বিজেপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে ধীরুভাই আম্বানি সদ্ভাব বজায় রেখেছেন  আগে থেকেই। কিন্তু আম্বানিকে পছন্দ করতেন না দলের কতিপয় বিধায়ক। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন যশবন্ত সিং। যশবন্ত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আম্বানির বিরুদ্ধে সমালোচনা করে চলেছেন। এছাড়া সম্প্রতি আদভানির ঘনিষ্ঠ আইন উপদেষ্টা হয়েছেন আম্বানির চরম শত্রু এস. গুরুমূর্তি। তাই বিজেপি শিবিরেও তার অবস্থা খুব পোক্ত হওয়ার আশা নেই।

এছাড়া আরেকটি কারণে বিজেপির অনেক নেতা বিশ্বাস করতেন না আম্বানিকে। তারা মনে করেন, ১৯৯৫ সালের মার্চে গুজরাটে প্রাদেশিক নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতা গ্রহণের সময় বিজেপি দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করেছিলেন আম্বানি। বিজেপি নেতা ও সদ্যনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেলের সঙ্গে দলের নিচুবর্ণের নেতা শঙ্করসিন ভাগেলার মতবিরোধ হয়। এতে ভাগেলাকে সমর্থন দেন ধীরুভাই। এরপর বাজপেয়িকে ফোন করে ভাগেলাকে ডেপুটি মুখ্যমন্ত্রীর পদ দেওয়ার সুপারিশ করেন। বাজপেয়ি অবশ্য সংকোচের সঙ্গে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর এক বছর পরে প্যাটেলের অনুসারীদের ত্যাগ করে কংগ্রেসের সহায়তায় নিজেই আলাদা দল গঠন করলেন ভাগেলা। অনেকের ধারণা, কংগ্রেসের সঙ্গে ভাগেলার এ মিত্রতার পেছনের কারিগর ধীরুভাই। কিন্তু এটা স্পষ্ট নয়, কেন তিনি এ ভাঙন চেয়েছিলেনÑবিজেপিকে জাতীয়ভাবে দুর্বল করার জন্য নাকি কেবল নিজের ইন্ডাস্ট্রিয়াল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রাদেশিক সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে।

শেয়ার সুইচিং মামলার কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে রিলায়ান্সের। এখন পর্যন্ত আর্থিক ক্ষতির চেয়ে ভাবমূর্তির ওপর আঘাতটাই বেশি। সিকিউরিটি বোর্ড ও ডিপার্টমেন্ট অব কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স এ মামলা রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে বিস্তর তথ্য-প্রমাণ জড়ো করেছে বলে শোনা যাচ্ছে। এখন বিচারের দায় কোন কর্তৃপক্ষ নেবেÑতা নিয়ে রশি টানাটানি চলছে। কিন্তু এ সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই ১৯৯৬ সালের মে মাসে শুরু হয়ে গেল নির্বাচন। নির্বাচনে সামান্য ব্যবধান নিয়ে জয়ী হলো বিজেপি। নির্বাচনের ফল হয়তো খুব একটা সম্ভাব্য ছিল না। অর্থাৎ হয়তো বিজেপি আশা করেনি যে, তারা জয়লাভ করতে পারবে। তাই সরকার গঠনের সময় তারা বুঝতে পারছিল হয়তো জনসমর্থন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। যা-ই হোক, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পাঠ করলেন অটল বিহারি বাজপেয়ী। যশবন্ত সিং হন অর্থমন্ত্রী এবং আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান রাম জেথমালানি। অর্থাৎ ক্ষমতার কেন্দ্রে ধীরুভাইবিরোধী বলয় তৈরি হলো। মজার ব্যাপার হলো, এই প্রথম ক্ষমতা পাওয়া বিজেপি সরকার স্থায়ী হয়েছিল মাত্র দুই সপ্তাহ। কিন্তু এরই মধ্যে যশবন্ত সিং ধীরুভাইয়ের ওপর শোধ তুলেছিলেন। কোম্পানি আইন লঙ্ঘনের দায়ে রিলায়ান্সের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিস ইস্যু করেন তিনি। এ আদেশের অনুমোদন পাস করান জেথমালানি। জেথমালানি আইনগত দিক থেকে তার কাজটুকু করে দিয়েছেন। এরপর বাস্তবায়নের দায় পড়ে পরবর্তী সরকারের ওপর। কিন্তু পরবর্তী সরকার এ আদেশ কার্যকর করতে কতটুকু সচেষ্ট হবেÑতাও এক অনিশ্চয়তার ব্যাপার।

বিজেপিকে হটিয়ে ক্ষতায় আসে ১৩ দলীয় ঐক্যজোট। এ জোটে মিত্রের অভাব নেই আম্বানির। খোদ নতুন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেব গোড়ার সঙ্গে আম্বানির রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। এর আগে কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন দেব গোড়া। আম্বানির এক্সিকিউটিভ জেটে চড়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দিতে গিয়েছিলেন তিনি। যশবন্ত সিংয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মুম্বাই ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আম্বানি ও তার কোম্পানির অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মোট ২৯টি অভিযোগ দায়ের করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো ইচ্ছাকৃত প্রতারণার চেষ্টা। কিন্তু নতুন সরকারের আমলে এসব মামলা কোনো বিরাট পরিণতি ডেকে আনেনি। বরং নকল শেয়ার ও সুইচিং-সংক্রান্ত ব্যাপারটি পুরোপুরি ঢাকা দেওয়া হলো একটি যৌগিক অভিযোগের আওতায়। এতে প্রযুক্তি আইন লঙ্ঘনের দায়ে কিছু জরিমানা করা হয়। আদালতে শুনানিও মওকুফ করা হয়। রিলায়ান্স প্রযুক্তিগত অব্যবস্থাপনার কথা স্বীকার করে। তাদের পক্ষে বলা হয়, এটা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি। কোম্পানির রেজিস্ট্রিতে অতিমাত্রায় চাপ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এতে কোনোভাবেই শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল না। তাদের ধোঁকা দিয়ে রিলায়ান্সের কোনো প্রকার আর্থিক লাভের সম্ভাবনা নেই। ম্যাজিস্ট্রেট এএম থিপসেও সম্মত হন যে, এ কর্মকাণ্ড নিয়মবহির্ভূত হলেও ইচ্ছাকৃত প্রতারণা নিশ্চয়ই নয়।

এ মামলার রায়ে রিলায়ান্সকে যে শাস্তি দেওয়া হয়, তা কোম্পানিটির প্রতিযোগী ও ধীরুভাইয়ের ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে খুবই লঘু মনে হয়েছে। মোট ৬৩ লাখ ৯৬ হাজার রুপি জরিমানা করা হয় কোম্পানিকে। পাশাপাশি রিলায়ান্স কনসালট্যান্সি সার্ভিসকে পরবর্তী ছয় মাসের জন্য সব ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ রাখার আদেশ দেওয়া হয়। এতে পত্রপত্রিকায় রিলায়ান্সের প্রতি সরকারের সহানুভূতিশীল আচরণকে কটাক্ষ করা হয়। অবশ্য পুরো ঘটনা থেকে ধীরুভাই একটা শিক্ষাও পেয়েছেন। রিলায়ান্স এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ব্যবসা করছে। পুঁজি আহরণ করছে লন্ডন ও হংকংয়ের মতো বড় মার্কেট থেকে। তাই প্রসার ও সুনাম অক্ষুণœ রাখতে হলে আর্থিক হিসাবের শুদ্ধতা বজায় রাখতেই হবে। তবে অর্থবাজারে এমন নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ড আরও অনেক কোম্পানিই করেÑএটা সত্য। তবে আইনের অঙ্গুলি আম্বানির দিকে নির্দেশ করার বিশেষ কারণ পাঠকের অজানা নয়। নুসলি ওয়াদিয়া, রাম জেথমালানি, এস. গুরুমূর্তি, যশবন্ত সিং ও অন্য রাজনৈতিক নেতাদের একটি বিরাট বিরুদ্ধ বাহিনী কখনোই আম্বানির পিছু ছাড়েনি। অবশ্য শেষ খেলাটি তিনিই খেলেছেন। একে একে সব বিপত্তির মোকাবিলা করে সামনে এগিয়ে গেছেন। লড়াই করে গিয়েছেন শেষ অবধি।

নকল শেয়ার ও সুইচিং মামলাকে বোম্বে ডায়িংয়ের সঙ্গে পলিয়েস্টার যুদ্ধের শেষ খণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা যায়। এ মামলায় শাস্তির পরিমাণ কম হলেও এটি যে দুর্নাম বয়ে এনেছিল তার প্রভাব ছিল ব্যাপক। আম্বানি ও তার রিলায়ান্সের মূল শক্তি বিনিয়োগকারীরা। দফায় দফায় খারাপ সময় এসেছে। বিরাট অঙ্কের জরিমানা গুনতে হয়েছে। হয়রানির শিকার হতে হয়েছে অনেকবার। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা প্রকৃতার্থে কখনোই আম্বানিকে ছেড়ে যায়নি। ভরসা রেখেছে তার ওপর। অথবা বলা যায় আম্বানি সম্মোহিত করে রাখতে পেরেছেন তাদের। প্রাইভেট সেক্টরে ভারতের এক নম্বর কোম্পানি হিসেবে রিলায়ান্সের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন তিনি। তিনি নিজে ভীষণ উচ্চাকাক্সক্ষী। সাধারণ বিনিয়োগকারীদেরও স্বপ্ন দেখিয়েছেন শিল্পোন্নত ভারতের। রিলায়ান্সের মতো এত লাভজনক বিনিয়োগ ও সর্বোচ্চ ডিভিডেন্ডও দিতে পারত না কোনো কোম্পানি। তাই ছোট ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের কাছে পুঁজিবাজারের ঈশ্বরে পরিণত হয়েছিলেন আম্বানি। কিন্তু শেয়ার সুইচিংয়ে মামলার পর পুঁজিবাজারে আম্বানির ঐশ্বরিক ভাবমূর্তি খর্ব হলো। অর্থ ব্যবস্থাপনায় রিলায়ান্সের দক্ষতাকে এক প্রকার চালাকি হিসেবে উপস্থাপিত হলো বটে। কিন্তু ঠিক কীভাবে রিলায়ান্স কনসালট্যান্সি সার্ভিস এ বিরাট চালাকিটি করতে পেরেছিল, তা প্রমাণিত হয়নি কখনোই।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০