কর্মজীবী নারী: ঘর ও গেরস্থির কথোপকথন

মাসুদ পারভেজ: সুমাইয়া আর ইশতিয়াক, স্বামী-স্ত্রী দুজনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। অফিস শেষে বাসায় এসে ড্রয়িংরুমে আধ-পড়া পত্রিকাটা শেষ করার আগেই নাশতা পায় ইশতিয়াক। তার টেলিভিশনে বিভিন্ন নিউজ আর খেলার চ্যানেল ঘুরাতে ঘুরাতে সুমাইয়ার রাতের রান্নাও শেষ হয়। মেয়ে দুটো মাঝে মাঝে বাবার কাছে এসে আবদার করে বটে কিন্তু পড়ানোসহ প্রাত্যহিক সমস্ত কাজ নিয়মিত সুমাইয়াকেই করতে হয়। সুমাইয়া আর ইশতিয়াক দম্পতির মাসের ছাব্বিশ দিনের রোজনামচা এটা। ছুটির দিনে ঘর-দোর, কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করা, একটু বিশেষ খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করাতো আছেই। ইশতিয়াক আবার খাবার-দাবার আর পোশাক-আশাকে একটু খুঁতখুঁতে, কাজের বুয়ার কাজ তার একদম পছন্দ হয় না। এর সঙ্গে মাসের যেকোনো সময় হাজির হওয়া আত্মীয়-স্বজনদের খাতির-যত্ন সুমাইয়াকেই করতে হয়।

সীমা, পাভেল, মেজবাউল, সাদিয়া একই সরকারি অফিসে চাকরি করে। ছেলেরা ঘরের কাজ করবে, তা সীমার একদম পছন্দ নয়। সে তার বরকে কখনোই রান্নার ঘরে ঢুকতে দেয় না। মেজবাউলের ‘বউকে মাথায় তুলে রাখা, বেশি বেশি তোল্লাই দেয়ার বিষয়ে ঘোর আপত্তি। পুরুষ মানুষের কাজ অর্থ উপার্জন করা, মেয়েলোকের কাজ পুরুষদের সেবা-যত্ন করা’এমন ধারণা পোষণ করে মেজবাউল। সাদিয়া চায় তার বর তার কাজে একটু সাহায্য করুক। বিয়ের প্রথম দিকে এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা হলেও এখন সে আশা ছেড়ে দিয়েছে সাদিয়া। এদের মধ্যে একমাত্র হাসির পাত্র হলো পাভেল, যে অফিসেও কাজ করে আবার বাসার বউয়ের সব ফুট-ফরমায়েশ খাটে, বউকে সাহায্য করে কাজে।

২০১৯ সালে একটি বেসরকারি জরিপে পনেরো থেকে চব্বিশ বছর বয়সী কিশোর-যুবাদের কাছে দুটি বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছিল ‘বাচ্চা খাওয়া-দাওয়া করানো, প্রস াব-পায়খানা পরিষ্কার করানো এবং গোসল করানো মায়েদের কাজ।’ আরেকটি ‘বাড়ি ও পরিবার দেখাশোনা করা নারীর কাজ।’এ বক্তব্য দুটিতে অধিকাংশই সম্মতি দিয়েছে। যার অর্থ হলো বর্তমান প্রজন্ম এই শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠছে যে, বাচ্চা লালন-পালন, গৃহস্থালির যাবতীয় কাজ, পরিবারের অন্য সদস্যদের সার্বিক দেখভালের কাজ নারীদের; এগুলো পুরুষদের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না।

এ হলো আমাদের সমাজের বা রাষ্ট্রের প্রচলিত বা আধিপত্যশীল ধ্যান-ধারণা, যার সঙ্গে যুক্ত আছে হাজার বছরের অচলায়তন, কুসংস্কার আর অন্ধবিশ্বাস। মানুষের ভেতরগুলো যদি বদলানো না যায়, তাহলে মনের ভেতরে গেঁথে থাকা এ সংস্কারগুলোও বদলানো যাবে না, সম্পর্কগুলোও এগিয়ে নেয়া যাবে না। সম্পর্ককে বিকশিত করতে নারী ও পুরুষের যৌথ অনুশীলন প্রয়োজন। যুগ যুগ ধরে বিশ্বে সে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তা পুরুষ পৃথিবীর, পুরুষতন্ত্রের সংস্কৃতি। আধিপত্যশীল সংস্কৃতি নারীকে অবদমনের জন্য তার কপালে জুড়ে দেয় সর্বংসহা, আত্মত্যাগী, সেবাপরায়ণা, পতিব্রতা, পতিমুখীর মতো অনাবশ্যক মহিমা। কিংবা কলঙ্কের মুকুট, সংসার-চাকরি-সন্তান এই তিনের বোঝা নারীকে একাই বইতে হয়; সন্তানের অসুখ, পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপÑসব দোষই গিয়ে পড়ে কর্মজীবী নারীর কাঁধে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী কর্মজীবী নারী কর্মজীবী পুরুষের তুলনায় কাজ করে তিনগুণ। পুরুষ ও নারী উভয়ই কর্মজীবী এমন পারিবারিক পরিবেশে একশতে পঁচাশি জন নারীকে রান্নার কাজটি করতে হয়; ৮৯ জন কাপড় ধোয়ার কাজটা নিজেই করে। ঘর পরিষ্কারসহ বাসার বিভিন্ন জিনিস সাফসুতরো রাখার কাজ করে থাকে ৮৮ জন নারী। পরিবারের শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ সদস্যদের দেখভালের দায়িত্বও বেশিরভাগ কর্মজীবী নারীকে সামলাতে হয়। ৫৩ শতাংশ নারী নিয়মিত এ কাজটা করে থাকে। এ জরিপ অনুযায়ী কর্মজীবী নারীরা পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পাচ্ছে না।

এখনো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমান সময় ও সমান কাজ করেও মেয়েরা কম মজুরি পায়। কারণ পুরুষের কাজ নাকি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বেশি ঝুঁকির, বেশি ভারবহ। বৈষম্যের এ ছক গণচেতনায় সেঁটে বসে আছে। তা থেকে মুক্তি এখনো মেলেনি। মুক্তির সচেতনতা অবশ্য বেড়েছে। যদিও সব জায়গায়, সবার ভেতরে সমান নয়। রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থা গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিলেও তার ভেতরেই গণমানুষের পছন্দক্রমে নারীর প্রতি বৈষম্যের ইতিহাস-তাড়িত ও অভ্যাস-লালিত মনোভাব ঘাপটি মেরে থাকে। এমনকি নারী সমাজের বাধ্য-অনুগত অংশও গড্ডলিকা প্রবাহে তাতে সাঁয় দেয়। তাই শুধু আইন করে বা সচেতনতামূলক প্রচার করে এ পরিবর্তন হবে না, দরকার মনোজাগতিক পরিবর্তন, সামাজিক সংস্কার।

কর্মজীবী নারীরা কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়। অনেক উচ্চ পেশায় নিয়োজিত নারীও সন্তান জšে§র পর চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মাতৃত্ব ও কর্মস্থলের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ঘরে-বাইরে কোথাও থেকে তারা সহযোগিতা পায় না। জেন্ডার বৈষম্য থেকে শুরু করে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হতে হয়। এসব সমস্যার কারণে অনেকে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও কর্মজীবনে প্রবেশ করতে আগ্রহী হয় না। কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে নারীদের কর্মসন্তুষ্টি হ্রাস পায়, সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়, এমনকি চাকরি হারানোর মতো ঘটনাও ঘটে।

যেকোনো দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নারী-পুরুষ সবার অংশগ্রহণ জরুরি। অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে দূরে ঠেলে প্রকৃত উন্নয়ন তথা টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হলো জেন্ডার সমতা এবং সব নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সক্ষমতা অর্জনের মতো বিষয়গুলো ভীষণভাবে জড়িত।

শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের বিচরণ বাড়লেও এখনো পেশাজগতে নারীর আগমন তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি। মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে সব সময়েই এক ধরনের মনোজাগতিক বাধা থাকলেও বর্তমানেও তা দূর হয়নি, যার প্রভাব পড়ে নারীদের চাকরি জীবনে প্রবেশে বা চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে। সরকারি চাকরির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীর হার ২৭ থেকে ২৮ শতাশের মধ্যে আটকে আছে। প্রথম শ্রেণিতে নারী কর্মকর্তা আছে আবার ২০ শতাংশ। ৭৭ জন সচিবের মধ্যে নারী আছে ১১ জন অর্থাৎ সরকারের শীর্ষস্থানীয় ও নীতিনির্ধারণীয় পদে নারীর অংশগ্রহণ এখনও উল্লেখযোগ্য নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা (গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক) রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি চাকরি বদলিযোগ্য হওয়ায় নারীদের এ বিষয়ে পরিবার থেকে একধরনের প্রতিবন্ধকতা কাজ করে। সমাজের একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিও আছে’।

তবে, আশার কথা হলো, বিশ শতকের শেষে নতুন যে প্রযুক্তি বিপ্লব শুরু হয়, সেখানে গায়ের জোর গৌণ মানিত। নারী-পুরুষের সমক্ষতা এখানে স্পষ্ট। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী-শ্রমই বেশি পছন্দের। যেমন পোশাক শিল্পে। আবার প্রযুক্তি এখানে হয়ে দাঁড়িয়েছে অনেক বেশি শিক্ষানির্ভর। মেয়েরা যেভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে নানান সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। নারীরা এর ভেতরও এগিয়েছে অনেক দূর।

রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সবক্ষেত্রে নারীদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধার দিকে বর্তমান সরকার নজর রাখছে। জাতীয় সংসদ ও স্থানীয় পরিষদে সংরক্ষিত নারী আসন বৃদ্ধি করেছে, জাতীয় সংসদের স্পিকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক উচ্চপর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্মজীবী নারীদের আবাসন সুবিধার জন্য ঢাকায় ও ঢাকার বাইরে ১০টি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ করা হয়েছে। ১২০টি ডে-কেয়ার সেন্টারের মাধ্যমে কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য যতœ ও সেবা প্রদান করা হচ্ছে। সরকারি কর্মজীবী নারীদের কল্যাণের জন্য যথাসম্ভব তাদের পরিবারের কাছাকাছি পদায়ন, আবাসনের ব্যবস্থা ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিতের ব্যবস্থা করছে সরকার। তৃণমূল পর্যায়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন নারী উদ্যোক্তাদের উৎপাদিত পণ্য ব্যবসায় সম্পৃক্ত করে আত্মকর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের কার্যক্রম গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে জয়িতা ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। পণ্য বাজারজাত ও বিপণনের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে ‘অঙ্গনা’।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাছাকাছি এসেও আমরা বৈষম্যের এক কুম্ভীপাকে যেন অবিরাম ঘুরপাক খাচ্ছি। পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিজে এ বৈষম্যবলয় থেকে বেরিয়ে রাতারাতি আসবেÑএমনটা আশা করা যায় না। তবে, এ কথা সত্য নারীদের আজকের মতন অর্জন, যতখানি অগ্রসরতা, সেখানে পুরুষের সহযোগিতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, কোনো কারণ নেই মূলত। প্রকৃত পক্ষে সাম্য ও ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য যে পরিবর্তন প্রয়োজন, তার দায়দায়িত্ব শুধু নারীদেরই নয়, আর সবারও তা কাঁধে তুলে নেয়া সমান জরুরি। তবে নারীর কথা নারীকেই বেশি বেশি বলতে হবে। আধিপত্যশীল ধ্যান-ধারণায় কর্মনিযুক্তিতে ও কর্মক্ষেত্রের পরিবেশে পুরুষ মানসিকতার নানা বাধা ও নানা বিপত্তি আগে থেকেই তৈরি থাকেÑএসবের সঙ্গে লড়াই করে মেয়েদের আপন বলয় তৈরি করে নিতে হবে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা ও সরাসরি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা মনের আড় ভেঙে দেয়। মেয়েরা আত্মপ্রত্যয়ী, সাহসী ও স্বাবলম্বী হয়। সে অঙ্গীকার, প্রত্যয় এবং আত্মবিশ্বাস নিয়েই নারীদের এগিয়ে যেতে হবে।

পিআইডি নিবন্ধ

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০