স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাওয়ার পর বাংলাদেশকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের রপ্তানিপণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। ক্রেতারা শিল্পে পরিবেশবান্ধব পরিবেশ, শ্রমিক সুরক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এগুলো বিবেচনায় ক্রেতারা কেনেন। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে কীভাবে কাজ হয় জাহাজ ভাঙা শিল্প না দেখেও যে কেউ অনুমান করবেন, এটি ঝুঁকিপূর্ণ।
গতকাল শেয়ার বিজে প্রকাশিত প্রতিবেদন ‘জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডে এক মাসে পাঁচ শ্রমিক নিহতের রেকর্ড’ এ শিল্পের শ্রমিকদের হতাশ করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাজ ভাঙার ইয়ার্ডের কর্মপরিবেশ মানসম্মত না হওয়ায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় শ্রমিক হতাহত হন। গত এক মাসে সাতটি দুর্ঘটনায় পাঁচজন শ্রমিকসহ চলতি বছরের এ পর্যন্ত ১৩ জন মারা যান।
সীতাকুণ্ডে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডের শ্রমিক হতাহতের এ তথ্য বিশ্বব্যাপী জাহাজ ভাঙা ও এর ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে কাজ করা বেলজিয়ামভিত্তিক গবেষণা সংস্থা শিপব্রেকিং প্ল্যাটফর্মের। আমাদের জাহাজশিল্পের মালিকরা অস্বীকার করলেও সংস্থাটির তথ্য অমূলক নয়। নানা কারণেই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বাংলাদেশ সম্ভাবনাময়। এর মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে তুলনামূলক কম খরচ। এতে বিপুলসংখ্যক দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। প্রতি বছরই চট্টগ্রামের ইয়ার্ডগুলোয় সনাতনী পদ্ধতিতে জাহাজ কাটতে গিয়ে বিস্ফোরণ, বিষাক্ত গ্যাসে দমবন্ধ হয়ে, লোহার পাত পড়ে প্রাণ হারান অনেক শ্রমিক। এ ছাড়া শ্বাসকষ্ট, ক্যানসারসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকি তো আছেই। পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেক শ্রমিক। এসব শ্রমিকের সুরক্ষায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি না, সেটি দেখতে হবে। রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন ফ্যাশনস অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর বড় সংকটে পড়েছিল পোশাক খাত। এ ধরনের বিপর্যয়ের আগেই জাহাজ শিল্প শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা, তেজস্ক্রিয়তা থেকে রক্ষায় বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো অনিয়ম যেন সম্ভাবনাময় এ শিল্পের গতিপথ রুদ্ধ করতে না পারে।
জাহাজ নির্মাণ শিল্প পুরোনো জাহাজ ব্যবহার করা হয়। এ শিল্পের বড় সীমাবদ্ধতা হলো, পরিবেশ দূষণ ও শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীনতা। মালিকরা টাকার পাহাড় গড়লেও শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা বরাবরই উপেক্ষিত। জাহাজ কাটার আগে বর্জ্য, বিষাক্ত গ্যাস ও বিস্ফোরকমুক্ত করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা যথাযথভাবে অনুসৃত হয় না। প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা কাজ করছেন। অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করে বিধায় শ্রমিকরা আহত বা নিহত হলে অনেক নিয়োগকর্তা শ্রমিকদের দায় নেন না। এমনকি শ্রমিকদের ন্যূনতম ব্যক্তিগত আত্মরক্ষামূলক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। মৃত্যুঝুঁকি নিয়েই শ্রমিকরা বছরের পর বছর কাজ করে চলেছেন। রাতের বেলায় ইয়ার্ডে কাজ না করার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও মালিকরা তাও মানছেন না।
মনে রাখতে হবে, এত বঞ্চনার পরও এ শ্রমিকদের অবদানেই জাহাজ ভাঙা শিল্প এখন মজবুত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। করোনাকালেও এ শিল্প দাপট লক্ষণীয়। এ অবস্থা ধরে রাখতে এ খাতে কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে, শ্রমিক সুরক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।