মাসুম বিল্লাহ: দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। প্রতিবছর নতুন করে কমপক্ষে ২০ লাখ নতুন মুখ যুক্ত হচ্ছে শ্রমবাজারে। কিন্তু তাদের কমংস্থান সৃষ্টির জন্য বাজেটে নির্দিষ্ট করে কোনো রূপরেখা থাকে না। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এলেও সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তাই বরাবরের মতো সুনির্দিষ্ট কর্মসংস্থানের কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই ঘোষিত হচ্ছে নতুন অর্থবছরের বাজেট।
প্রতিটি দেশের বাজেটে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বেকারত্ব কমানোর একটি রূপরেখা থাকে। এটিই থাকে বাজেটে তরুণদের মূল আকর্ষণ, কিন্তু বাংলাদেশে তা উপেক্ষিত। ২০১০ সালে সরকারিভাবে ন্যাশনাল সার্ভিসের আওতায় কিছু সাময়িক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও নানা অনিয়মের কারণে তা টেকসই হয়নি। এরপর নতুন করে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১০ কোটি ৯১ লাখ। এর মধ্যে কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছয় কোটি আট লাখ। তার মধ্যে বেকার ২৬ লাখ ৮০ হাজার। বাকিরা বিভিন্ন ধরনের কর্মে নিয়োজিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু এর মধ্যে ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান। ফলে এ খাতে অনেক ছদ্ম বেকরারত্ব রয়েছে। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী, সপ্তাহে কেউ এক ঘণ্টা কাজ করলেও তাকে বেকার বলা যাবে না। ফলে যাদের কর্মে নিযুক্ত হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তাদের অনেকেই বেকার।
জানা যায়, গত সাত বছরের ব্যবধানে দেশের মোট জিডিপির আকার দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে চলতি মূল্যে দেশের মোট জিডিপির আকার ছিল প্রায় ১২ লাখ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে তা বেড়ে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়েনি কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থান প্রত্যাশিত মাত্রায় না বাড়ার জন্য সরকারের নীতি সহায়তার অপর্যাপ্ততাকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য সবচেয়ে আগে প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিন্তু বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য যে ধরনের নীতিগত সহায়তা দরকার, তা নিশ্চিত করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা এবং জমির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার অগ্রগতি খুবই শ্লথ। এখনও বড় ধরনের কোনো দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগ সেখানে হয়নি। ফলে কর্মসংস্থান বাড়ানোর প্রাথমিক কাজগুলোই হচ্ছে না।
২০০৮ সালের নির্বাচনের ইশতেহারে ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল মহাজোটের। সে প্রতিশ্রুতি পূরণে ২০১০ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যাশনাল সার্ভিস প্রকল্পের ঘোষণা দেন। এর আওতায় দেশের তিন জেলা কুড়িগ্রাম, গোপালগঞ্জ ও বরগুনায় ৫৫ হাজার ৮৮৬ বেকার তরুণ-তরুণীকে চাকরি দেওয়া হয়। তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানেই নানা কাজে সহযোগিতার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে বহু আগেই। এর পর নির্দিষ্টভাবে বাজেটে কর্মসংস্থান বিষয়ে কোনো রূপরেখা দেওয়া হয়নি। আগামী বাজেটেও এক বছরে কত সংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, তার কোনো রূপরেখা থাকছে না বলে জানা গেছে।
তবে ন্যাশনাল সার্ভিসের মতো কার্যক্রম টেকসই নয় বলে মন্তব্য করেছেন ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, এ ধরনের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বেকারত্ব কমাতে পারলেও দীর্ঘমেয়াদে কোনো শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না।
জানা যায়, আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় এর আকার প্রায় ২১ শতাংশ বেশি। এ বাজেটের বড় অংশই যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও তাদের পেনশন পরিশোধে। আর টাকার অঙ্কে বাড়লেও আনুপাতিক হারে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মতো খাতে বরাদ্দ কমছে। চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতের বরাদ্দ একসঙ্গে উপস্থাপন করায় প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন এবং কর্মের জন্য দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরিতে বাজেটের কত শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে ঘোষণা থাকা উচিত কি না সে বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেটে সরাসরি কর্মসংস্থানের সংখ্যা উল্লেখ করা না হলেও এমন কিছু পদক্ষেপ থাকা উচিত যা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন কৃষি খাতের জন্য কিছু প্রণোদনার ঘোষণা থাকতে পারে। মূলত বিনিয়োগের অভাবেই নতুন কর্মসংস্থান বাড়ছে না। বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য আইনি সংস্কারসহ বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নয়ন করতে হবে।
সরকারি হিসাবে দেশে প্রতি বছর জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। সেইসঙ্গে বাড়ছে সরকারি বিনিয়োগও, কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না কর্মসংস্থান। অন্যদিকে বাড়ছে বেকার মানুষের সংখ্যা। বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে কর্মসংস্থান কমেছে প্রায় এক লাখ। পাশাপাশি এক বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার। ছদ্ম বেকারত্ব বাদ দিলে এ সংখ্যা বহুগুণে বাড়বে।
এদিকে সরকারের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও ভিশন-২০২১ প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। মূলত বাজেটের মাধ্যমেই ওইসব পরিকল্পনা বাস্তব রূপ পাওয়ার কথা। কিন্তু বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে এসব পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন আশানুরূপ নয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে কমংসংস্থান সৃষ্টির বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। কিন্তু সে লক্ষ্য কোন উপায়ে অর্জিত হবে, সে বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর কাজ করার কথা। আর বাজেটে কোনো উদ্যোগ আছে কি না, সেটা জানতে আমাদের বাজেট ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
ন্যাশনাল সার্ভিসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ ধরনের কর্মসূচি অনেক দেশেই সফল হয়েছে। তবে এ কর্মসূচি থেকে সব দেশেই যে একই রকম ফল পাওয়া যাবে, তেমনটি নয়।
জানা যায়, আগামী অর্থবছর মোট বাজেটের আকার দাঁড়াতে পারে চার লাখ ৬৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতি প্রাক্কলন করা হচ্ছে এক লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতির মধ্যে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৮৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকার সংস্থানের প্রাক্কলন করা হয়েছে। আর বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তির প্রত্যাশা করা হচ্ছে ৩৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরের জন্য মোট জিডিপির আকার প্রাক্কলন করা হচ্ছে ২৫ লাখ ৩৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সাত দশমিক আট শতাংশ প্রবৃদ্ধি ও পাঁচ দশমিক ছয় শতাংশ মূল্যস্ফীতি ধরে এ জিডিপি প্রাক্কলন করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
কর্মসংস্থান বৃদ্ধির রূপরেখা ছাড়াই আসছে মেগা বাজেট
