একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার প্রো-এজ অ্যাসোসিয়েটসের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও হামীম গ্রুপের মানবসম্পদ (এইচআর) বিভাগের কনসালট্যান্ট ড. উলফাত হোসেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস
ড. উলফাত হোসেন প্রো-এজ অ্যাসোসিয়েটসের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও হামীম গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগে কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে এমবিএ ও ডক্টর অব বিজনেস অ্যাডমিনস্ট্রেশন (ডিবিএ) ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি ইনস্টিটিউট অব লিডারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (আইএলএম) যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের (বিএসএইচআরএম) একজন সম্মানিত ফেলো
শেয়ার বিজ: ক্যারিয়ারের গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই…
ড. উলফাত হোসেন: ১৯৮১ সালে লিবিয়ায় ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করি। এরপর দেশে ফিরে আমেরিকান এম্বাসির মানবসম্পদ বিভাগে কাজ শুরু করি ১৯৮৭ সালে। দীর্ঘ ১১ বছর ওই প্রতিষ্ঠানে থাকার সুবাদে বিশ্বের অনেক দেশে কাজ করা ও প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয়। ২০০০ সালে একটি বহুজাতিক পাওয়ার প্লান্ট কোম্পানিতে মানবসম্পদ ও কমিউনিটি রিলেশনস বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিই। ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রেডিসন ব্লু হোটেলের মানবসম্পদ বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। ২০০৭ সালে দি ওয়েস্টিন হোটেলের মানবসম্পদ বিভাগের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নিই। ওখানে দুই বছর কাজ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশকিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এইচআর, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে পাঠদান শুরু করি। পাশাপাশি গার্মেন্টস সেক্টরের একটি প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগের কনসালট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করি। পরে প্রো-এজ অ্যাসোসিয়েটস এইচআর কনসালট্যান্সি ফার্মের সিনিয়র কনসালট্যান্ট হিসেবে যোগ দিই। ওই প্রতিষ্ঠানেরই একটি প্রজেক্ট হামীম গ্রপের এইচআর কনসালট্যান্ট হিসেবে বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছি।
শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে কেন বেছে নিলেন?
উলফাত হোসেন: মানবসম্পদ বা হিউম্যান রিসোর্স কনসেপ্ট নিয়ে কিছু বলি। একসময় মানবসম্পদ বিভাগকে অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বলা হতো। ওই বিভাগের কাজ ছিল কর্মী নিয়োগ দেওয়া ও ছাঁটাই করা। কেবল নিয়োগ আর ছাঁটাই করা যদি কাজ হয়, তাহলে তা হিউম্যান রিসোর্স হলো না। সাধারণত উদ্যোক্তারা প্রতিষ্ঠানে জমি, অর্থ বা ক্যাপিটালকে রিসোর্স হিসেবে দেখেন। কিন্তু শ্রমিক যে একটি রিসোর্স তা হয়তো উপেক্ষিত থেকে যায়। এই কনসেপ্ট ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের সময়ে শুরু হয়ে এখন পূর্ণতা লাভ করছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, সবাই প্রযুক্তি নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু এসব কিছু যারা পরিচালনা করছেন, সেই মানুষদের নিয়ে চিন্তিত নন। ‘মেশিনের পেছনে মানুষ’ এই বিষয়টি আনুধাবন করতে হবে। মানুষকে রিসোর্স হিসেবে ভাবতে হবে এবং তাদের দক্ষ কর্মী হিসেবে তৈরি করতে হবে প্রতিষ্ঠানের জন্য, দেশের জন্য এবং প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার জন্য।
প্রতিষ্ঠানের মালিক মনে করবেন কর্মীরা আমার সম্পদ। একইভাবে কর্মীদের ভাবতে হবে, ‘আমি যেখানে কাজ করছি সেখানে আমার ওনারশিপ আছে। ভালো লাগা থেকে কাজ করি; প্রতিষ্ঠান থাকলে, উন্নতি হলে আমার বৈষয়িক উন্নতি হবে, পরিবার বাঁচবে, জীবন বাঁচবে।’ কর্মীর মধ্যে এই ভাবনা থাকা উচিত। অন্য দিকে মালিককে ভাবতে হবে, ‘কর্মী ছাড়া আমার প্রতিষ্ঠান কখনও টিকতে পারবে না। এই কনসেপ্টকে সামনে নিয়ে হিউম্যান রিসোর্সকে সঠিকভাবে পরিচালনা বা ব্যবহার করতে হবে। আমরা ফ্যাক্টরির জন্য ভালো মেশিনের স্থাপনা নিয়ে ভাবছি, এর যত্ন নিচ্ছি, কিন্তু মানুষের যত্ন নিচ্ছি না। একজন মানুষ যার শরীর আছে, মন আছে, আছে পরিবার, সমাজ, দুঃখ-বেদনার অনুভূতি, সেই মানুষকে সুসংগঠিত করা, দক্ষ করে তোলা, তাকে দিয়ে কাজ আদায় করা প্রভৃতি বিষয় আমার কাছে বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়। একটি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বিভাগ থাকে, সেখানে একেকজন মানুষ একেকটি পেশায় কাজ করেন। এসব মানুষের প্রেষণার দিক নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা এবং সবাইকে একটা প্লাটফর্মে নিয়ে আসাটা বেশ চ্যালেঞ্জের। এই চ্যালেঞ্জ ভালো লাগে বলেই পেশাটিকে বেছে নিয়েছি।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগ ও দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা কী?
উলফাত হোসেন: প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মানবসম্পদ বিভাগ। প্রতিষ্ঠানের কর্মিবাহিনীকে সুসংগঠিত ও সংঘবদ্ধ করা এই বিভাগের অন্যতম কাজ। এছাড়া কর্মী বাছাই, নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া তো আছেই। কর্মীদের উন্নত করা, দক্ষতা বৃদ্ধি করা, কর্মীকে সঠিক জায়গায় নিয়োগ দেওয়া মানবসম্পদ বিভাগের কাজ। কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি করে প্রতিষ্ঠানের রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট (আরওআই) বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক।
শেয়ার বিজ: বাংলাদেশের এইচআর প্র্যাকটিস সম্পর্কে জানতে চাই।
উলফাত হোসেন: বাংলাদেশে এইচআর প্র্যাকটিস শুরু হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। কিন্তু খুব ভালো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, তা বলবো না। এখানে দুই ধরনের এইচআর প্র্যাকটিস লক্ষ করা যায়। যারা প্রতিষ্ঠানে সম্পূর্ণভাবে করপোরেট কালচার প্রতিষ্ঠা করতে চান তারা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে ও এর উন্নয়নে গুরুত্ব দেন। বহুজাতিক কোম্পানির পাশাপাশি দেশীয় কিছু প্রতিষ্ঠানও এ ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে। আজকাল প্রায় সব বড় ধরনের প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ বিভাগ আছে, কিন্তু সঠিক চর্চা হয় না। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই বেশি। তবে সুখের বিষয় হলো, অনেক প্রতিষ্ঠান এখন মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং দক্ষ মানবসম্পদ পেশাদারের বেশ চাহিদা সৃষ্টি হচ্ছে।
শেয়ার বিজ: দেশে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের অভাব রয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
উলফাত হোসেন: আমাদের দেশে প্রচুর মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক থাকলেও দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের সংখ্যা কম। দক্ষ বলতে কাজের দক্ষতা, নেতৃত্ব দেওয়ার দক্ষতা, মানুষকে বোঝা ও চালানোর দক্ষতা প্রভৃতিকে বুঝিয়েছি। এগুলোর সঙ্গে ব্যবসার ধরন, গতি ও প্রকৃতি বোঝার বিষয়টিও রয়েছে। ব্যবসা বুঝে কর্মীদের সেভাবে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায় মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের ভূমিকা রাখতে হয়। এই জায়গায় আমাদের অনেকের ঘাটতি রয়েছে। ব্যবসা বুঝতে গেলে সামান্য হলেও অ্যাকাউন্টস, ফাইন্যান্স, ইনভেস্টমেন্ট কিংবা কিছু ম্যাথমেথিটিক্যাল বিষয় জানতে হয়, কিন্তু অনেকে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চান। এ কারণে এইচআরের কাজ নেতৃত্ব দেওয়ার পরিবর্তে অনেকটা করণিক ধাঁচের হয়ে যায়। মোটকথা, আমরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছি না। এ হিসেবে বলা যায়, দেশে দক্ষ মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের অভাব রয়েছে।
শেয়ার বিজ: বাইরের দেশের তুলনায় বাংলাদেশের এইচআর প্র্যাকটিসের অবস্থান কেমন?
উলফাত হোসেন: বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয় অনেক আগে থেকেই এইচআর প্র্যাকটিস হচ্ছে, যে কারণে তারা অনেক এগিয়ে গেছে। একটা স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে পারছে। আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা পথভ্রষ্ট হইনি। সঠিক পথেই আছি। তাদের ওই পর্যায়ে যেতে আমাদের একটু সময় লাগবে। একটা সময় মানবসম্পদ বিভাগকে অ্যাডমিন বলা হতো, তারপর পারসোন্যাল এরপর হিউম্যান রিসোর্স। এখন আবার এটা পরিবর্তিত হয়ে হচ্ছে হিউম্যান ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট। এই পরিবর্তনটা উন্নত দেশেই প্রথম হয়। কয়েক বছর পর আমাদের দেশে শুরু হয়। তাদের সঙ্গে আমাদের কেবল সময়ের পার্থক্য। তবে পরিবর্তন আসছে, এইচআর কনসেপ্টের গুরুত্ব উদ্যোক্তারাও বুঝতে পারছেন।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকদের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় কী?
উলফাত হোসেন: মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকদের প্রতিটি কাজই চ্যালেঞ্জের। তা সব সময়ই থাকে। নিয়মিত চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে কর্মীদের দৈনন্দিন নানা রকম সমস্যার সমাধান করা। এছাড়া কর্মিবাহিনী ও মালিকপক্ষের মধ্যে সমন্বয় করা। কর্মীরা যেন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি না করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে প্রক্রিয়াগত বিষয় এবং দেশের আইন মেনে চলা। সব মিলিয়ে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে এগিয়ে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জের। আর এখানেই নিহিত রয়েছে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপকের পেশাদারি মহত্ত¡।
শেয়ার বিজ: যারা পেশা হিসেবে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগকে বেছে নিতে চান, তাদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কী?
উলফাত হোসেন: যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের সাধুবাদ জানাই। নতুনদের উদ্দেশে বলতে চাই, যেকোনো প্রতিষ্ঠানে আনন্দের সঙ্গে ভালোবেসে কাজ করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন তাকে নিজের সম্পদ ভাবতে হবে। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাতে নৈর্ব্যক্তিক পথপ্রদর্শন করতে হবে। নিজের সত্তাকে যেন বিকিয়ে না দেওয়া হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে কাজ করতে হবে।
এইচআর-সম্পর্কিত নতুন বই পড়তে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আর যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, সে প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরন ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে হবে। মালিক ও শ্রমিকের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতে হবে। তাহলেই একজন সার্থক এইচআর প্রোফেশনাল হতে পারবেন।