রহমত রহমান: মাত্র এক মিনিটে রিটার্ন দাখিল! অবিশ্বাস্য মনে হয়? না, অবিশ্বাসের কোন কারণ নেই। কর অঞ্চলের ‘মিনি’ করমেলায় মাত্র এক মিনিটে করদাতারা রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। শুধু রিটার্ন দাখিল নয়, মুহূর্তের মধ্যে কর সংক্রান্ত সেবা, রিটার্ন পূরণ ও ই-টিআইএন সেবা দেওয়া হচ্ছে।

ঢাকাসহ সারাদেশের প্রতিটি কর অঞ্চলে এ বিশ্বাস সেবা পাচ্ছেন করদাতারা। এছাড়া করদাতাদের মধ্যে অনেকেই ভোগান্তি ও করোনার সংক্রমণ এড়াতে বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউক্যাশসহ ছয়টি মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে কর পরিশোধ করতে দেখা গেছে। গতকাল রাজধানীর কয়েকটি কর অঞ্চল ঘুরে করদাতা ও কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
## আয়কর মেলার আদলে কর অফিসেও করদাতারা পাচ্ছেন ‘ওয়ানস্টপ’ সেবা
## করোনা সংক্রমণ রোধে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক পরিধান বাধ্যতামূলক
## বিকাশ, রকেট, নগদ, ইউক্যাশ ব্যবহার করে ঘরে বসেই দেওয়া যাচ্ছে কর

এনবিআর সূত্রমতে, ১০ বছর পর এবার আয়কর মেলা হচ্ছে না। বিশেষ করোনা সংক্রমণ রোধে এবার আলাদা জায়গায় মেলা না করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে মেলার আবহে কর অঞ্চল ও সার্কেলে কর সেবা সপ্তাহ পালন করা হবে। যাতে করদাতারা রিটার্ন দাখিলসহ সব ধরনের সেবা পাবেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে দেশের সব কর অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হচ্ছে মিনি করমেলা। তবে করোনা সংক্রমণ রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেয় এনবিআর।
কয়েকটি কর অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ কর অঞ্চলে মেলার আদলে আলাদা বুথ করা হয়েছে। যাতে রিটার্ন দাখিল, ই-টিআইএন নিবন্ধনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। করদাতা, সেবাগ্রহীতা ও কর্মকর্তাদের সংস্পর্শ এড়াতে করোনা প্রতিরোধী বুথ স্থাপন করা হয়েছে। বুথের সামনে দেওয়া হয়েছে গ্লাস। মাস্ক বাধ্যতামূলক করে বুথের সামনে সাঁটানো হয়েছে লিফলেট। করদাতাদের মাস্ক পরিধান ছাড়া সেবা দেওয়া হচ্ছে না। বুথে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারাও সংক্রমণ রোধে মুখে মাস্ক, হ্যান্ডগ্লাফ পরিধান করেছেন।

আবার কোথাও কোথাও বুথের সামনে লেন করা হয়েছে। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যেসব কর অঞ্চলে বুথ করার জায়গা নেই সেখানে প্রতিটি সার্কেলে কর তথ্য ও সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। করা হয়েছে রিটার্ন গ্রহণের বিশেষ বুথ। করোনা সংক্রমণ রোধে আগত করদাতাদের দেওয়া হচ্ছে হ্যান্ডওয়াশ, স্যানিটাইজার। রিটার্ন জমা দেওয়ার পরপরই দ্রুত স্থান ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে।
বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে রিটার্ন ফরম, চালান ফরম, আয়কর পরিপত্র ও নির্দেশিকা। কোন কোন অফিসে সিসি ক্যামেরায় সার্বক্ষনিক মনিটরিং করা হচ্ছে। কমিশনার থেকে শুরু করে উধ্বর্তন কর্মকর্তারা বুথ পরিদর্শন, সেবায় বিঘ্ন ঘটে কিনা-তা সার্বক্ষনিক তদারকি করছেন। আবার মেলা উপলক্ষে প্রতিটি কর অঞ্চল, সার্কেল অফিস সরকারের উন্নয়নের চিত্র সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে। করা হয়েছে আলোকসজ্জা।

রাজধানীর পল্টনে কর অঞ্চল-১২ ঘুরে দেখা যায়, ভবনে প্রবেশ পথ থেকে শুরু করে পুরো কর অঞ্চল নান্দনিকভাবে সাজানো হয়েছে। দেয়ালে সাঁটানো হয়েছে উন্নয়নের চিত্র। করোনা সর্তকর্তায় বিধি নিষেধ সম্বলিত সর্তকবাণী। কর তথ্য ও সেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যেখান থেকে বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে আয়কর ফরম, চালান ফরম, নির্দেশিকা। রিটার্ন পূরণে করদাতাদের সহায়তা করা হচ্ছে।

কর অঞ্চলের কনফারেন্স রুমে রিটার্ন গ্রহণ ও ই-টিআইএন সেবার পাঁচটি বুথ স্থাপন করা হয়েছে। এ কর অঞ্চলের ২২টি সার্কেলের আওতাধীন করদাতারা এসব বুথে রিটার্ন দাখিল করতে পারছেন। সংক্রমণ রোধে রিটার্ন দাখিল ও প্রাপ্তি স্বীকারপত্র সঙ্গে সঙ্গে করদাতাদের বুথ ত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। এছাড়া কমিশনার সারাক্ষণ রিটার্ন বুথ ও সার্কেল সার্বক্ষনিক মনিটরিং করছেন।
এ বিষয়ে কর কমিশনার মো. আবদুল মজিদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মেলার আদলে সব ধরনের সেবা দেওয়া হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ রোধে শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সেবা গ্রহণে করদাতাদের এবং সেবা প্রদানে কর্মকর্তাদের উদ্ধুদ্ধ করা হচ্ছে। আমি ও আমার টিম সার্বক্ষনিক মনিটরিং করছি, যাতে করদাতা সেবায় কোন বিঘ্ন না ঘটে।’
সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল-১০ ঘুরে দেখা যায়, অফিসের সামনে ছয়টি রিটার্ন গ্রহণ বুথ করা হয়েছে। এছাড়া অপর একটি সার্কেলে আরো তিনটি বুথ করা হয়েছে। করোনা সংক্রমণ রোধে বুথে গ্লাস লাগানো হয়েছে। যাতে করদাতা ও সেবাগ্রহীতা একে অপরের সংস্পর্শে না আসে। বুথের সামনে লেখা ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’। মাস্ক পরিধান ছাড়া রিটার্ন জমা নেওয়া হচ্ছে না।

এছাড়া সংক্রমণ সর্তকর্তায় রিটার্ন দাখিল করেই সটকে পড়ছেন করদাতা। রিটার্ন পূরণে সাজানো হয়েছে চেয়ার-টেবিল। করা হচ্ছে সহায়তা। একটি রুমে ই-টিআইএন সেবা দেওয়া হচ্ছে। ফরম বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে। মেলা উপলক্ষে সাজানো হয়েছে পুরো কর অফিস। এ কর অঞ্চলের আওতাধীন নরসিংদী জেলা কর অফিসেও একইভাবে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে কর অঞ্চল-১০ এর কমিশনার মো. লুৎফুল আজীম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘সর্বোচ্চ করসেবা নিশ্চিত করতে আমরা চেষ্টা করছি। মনিটরিং করা হচ্ছে। করদাতারা স্বাচ্ছন্দ্যে রিটার্ন দাখিল ও সেবা গ্রহণ করছেন। করোনা সংক্রমণ রোধে সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সেবা গ্রহণ ও প্রদানে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।’

সেগুনবাগিচায় কর অঞ্চল-৫ গিয়ে দেখা যায়, মেলা উপলক্ষে খোলা হয়েছে তথ্য কেন্দ্র। কোথায়, কি সেবা পাওয়া যাবে সেখান থেকে তা নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্বলিত ব্যানার-ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো কর অঞ্চল। করোনা সর্তকর্তার সরকারি নির্দেশনা, বিধি নিষেধ সাটানো হয়েছে। এই কর অঞ্চলের সার্কেল অফিস ২৮-২৯ কাকরাইল।
ওই ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলা থেকে নির্দেশনা সম্বলিত ফেস্টুন দেওয়া রয়েছে। সেই ভবনে ১৬টি সার্কেল রয়েছে। ভবনের করদাতাদের রিটার্ন পূরণ ও সেবাগ্রহণের জন্য বিশাল একটি ফ্লোর রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি সার্কেল নান্দনিক রূপে, সেবা সম্বলিত তথ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে। সার্কেলের সামনে আলাদা করে বুথ স্থাপন করা হয়েছে। রিটার্ন ফরম, চালান ফরম ও নির্দেশিকা দেওয়া হচ্ছে। সংক্রমণ রোধে করদাতাদের করা হচ্ছে সর্তক।

এ বিষয়ে কর অঞ্চল-৫ এর কমিশনার সোয়ায়েব আহমেদ শেয়ার বিজকে বলেন, ‘করদাতারা মেলার চেয়ে ভালো সেবা পাচ্ছেন। আমি ও আমার পুরো টিম তদারকি করছি। করোনা সংক্রমণ রোধে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মাস্ক পরিধানে আমরা সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছি। এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী, মেলায় সব ধরনের সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।’
মেলায় আগত কয়েকজন করদাতা জানিয়েছেন, মেলার চেয়ে কোন অংশেই কম সেবা দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিটি কর অঞ্চলে দ্রুত সময়ে ও আন্তরিকতার সাথে কর্মকর্তারা সেবা দিচ্ছেন। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মাসের প্রথম দিকে করদাতার সংখ্যা কম। দিন যত যাবে করদাতাদের ভিড় তত বাড়বে। এনবিআর চেয়ারম্যান সেবা গ্রহণ ও সেবা প্রদান তদারকির অংশ হিসেবে কর অঞ্চল পরিদর্শন শুরু করেছেন।

অপরদিকে, প্রচারণার অংশ হিসেবে করদাতাদের দেওয়া হয়েছে এসএমএস। প্রতিটি কর অঞ্চল করদাতার ই-টিআইএন দেওয়া মোবাইল নাম্বারে এ এসএমএস দেওয়া হয়েছে। যাতে লেখা হয়েছে-‘টিআইএন থাকলেই এ বছর আয়র রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক। জরিমানা এড়াতে ৩০ নভেম্বর ২০২০ এরমধ্যে আপনার রিটার্ন দাখিল করুন।’ এছাড়া অনেক কর অঞ্চল সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে করসেবা গ্রহণে চালাচ্ছে প্রচারণা। নিয়মিত ফেসবুক পেইজে করদাতা মিনি করমেলায় গিয়ে কি কি সেবা পাবেন তা জানান দেওয়া হচ্ছে।

এনবিআর সূত্র জানায়, করোনা মহামারির কারণে ১০ বছর পর প্রথমবার আয়কর মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। প্রতিবছর যত আয়কর রিটার্ন দাখিল হয় তার মধ্যে চতুর্থ দাখিল হয় আয়কর মেলায়। কর মেলার জন্য সাধারণ করদাতারা অপেক্ষায় থাকেন। মূলত কর মেলায় কোন ঝামেলা ছাড়া এবং উৎসবমুখর পরিবেশে রিটার্ন দাখিল, কর পরিশোধ করতে পারেন। সেজন্য করদাতাদের কাছে মেলা জনপ্রিয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১০ সালে সর্বপ্রথম এনবিআর আয়কর মেলার আয়োজন করে। শুরুতে তেমন সাড়া না পাওয়া গেলেও কালের পরিক্রমায় আয়কর মেলা ব্যক্তি শ্রেণির করদাতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। প্রতি বছরই করদাতাদের বড় অংশ মেলায় রিটার্ন দিয়ে থাকেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত মেলা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। গত বছর বিভাগীয় পর্যায়ে ৭ দিন, জেলা পর্যায়ে ৪ দিন ও উপজেলা পর্যায়েও আয়কর মেলার আয়োজন করা হয়। আর মেলা থেকে ২ হাজার ৬১৩ আয়কর আদায় হয়। মোট রিটার্ন জমা দেন ৬ লাখ ৫৫ হাজার করদাতা। সেবা গ্রহণ করে ১৮ লাখ ৬৩ হাজার ৩৮৭ জন।
###