কর অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হতে চায় এনবিআর

রহমত রহমান: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটতে চলেছে বাংলাদেশের। কিন্তু এখনও কর জিডিপির অনুপাত গত ১০ বছর ধরে ১০ শতাংশের কোটা পার হতে পারেনি। কর জিডিপির অনুপাত না বাড়ার পেছনে বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো কর অব্যাহতি। এনবিআর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, উন্নয়ন প্রকল্প, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগসহ বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে। এনবিআরের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, বছরে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা কর বা রাজস্ব অব্যাহতি দেয়া হয়। এই অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারলে ২০৩১ সালের মধ্যে কর জিডিপির অনুপাত ১৭ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা।

আবার কর অব্যাহতির কারণে অনেক সময় এনবিআর রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারে না। অব্যাহতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তর; যারা সরকারি বড় উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। তবে সরাসরি অব্যাহতি না নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বা কাজের বরাদ্দের সঙ্গে অব্যাহতির অংশ নিয়ে নেয়ার পক্ষে রয়েছে এনবিআর। সে জন্য সহযোগিতা চেয়ে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে অনুরোধপত্র দিয়েছেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। ‘রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা প্রদান’-এর জন্য এই অনুরোধপত্র দেয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়-বিভাগের সচিব, বিভিন্ন অধিদপ্তরের পরিচালক ও মহাপরিচালক, চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানসহ মোট ২১৮ জনকে এই অনুরোধপত্র দেয়া হয়।

চেয়ারম্যান অনুরোধপত্রে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটছে। বাংলাদেশ ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে দেশের চলমান উন্নয়নকে টেকসই করতে কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর বিকল্প নেই। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় কর-জিডিপির অনুপাত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম। মূলত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে শুল্ককর অব্যাহতির এ ক্ষেত্র আমাদের অবস্থানের উন্নতিতে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এ কর আদায় করা গেলে প্রকৃত কর জিডিপি অনুপাত বর্তমানের দ্বিগুণ হয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নকে অধিক মাত্রায় ত্বরান্বিত করা সম্ভব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’

অনুরোধপত্রে অব্যাহতির বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর একটি অনুশাসন তুলে ধরে বলা হয়, অব্যাহতির পরিবর্তে প্রযোজ্য শুল্ককর পরিশোধ সাপেক্ষে পণ্য ছাড়ের মাধ্যমে কর জিডিপির হার বৃদ্ধির বিষয়ে ২০১৬ সালের ১০ মে শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবদের উপস্থিতিতে উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে তিনটি অনুশাসন দেন। প্রথমত, ‘প্রতিটি কার্যক্রম, তা প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক বা কোনো মেরামত, সংরক্ষণ বা পরিচালনার বিষয় হোক, যে পণ্যদ্রব্য বা বিভিন্ন রসদ বা উপাদান সংগ্রহ বা খরিদ সম্পন্ন করতে, কত কর কোন খাতে দিতে হবে (মূসক, আমদানি শুল্ক বা সম্পূরক শুল্ক), তার হিসাব করে প্রয়োজনীয় অর্থ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং সেই বরাদ্দ থেকে শুল্ক, কর ইত্যাদি পরিশোধ করতে হবে।’

দ্বিতীয়ত, ‘কোন কোন ক্ষেত্রে কর শুল্কাদি মওকুফ করা বা নির্দিষ্ট হারে রেয়াত দেওয়া হবে, সেগুলো স্পষ্টভাবে আইন বা বিধিতে উল্লেখ থাকবে। যেমনÑজনকল্যাণকর প্রকল্প বা স্থাপনা বা কাজের জন্য আমদানি করা অনুদান সামগ্রী।’ তৃতীয়ত, ‘দেশে করভিত্তি সম্প্রসারণসহ কর জিডিপির অনুপাত কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত করতে হলে কর অব্যাহতির বিদ্যমান সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে সর্বক্ষেত্রে কর প্রদানের বিষয়ে করদাতাদের উৎসাহিত করা এবং তাদের এ বিষয়ে অভ্যস্ত করে তোলা দরকার।’

পত্রে আরও বলা হয়, অর্থমন্ত্রী ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অব্যাহতি বিষয়ে আরও একটি অনুশাসন দেন। তা হলো ‘বিভিন্ন খাতে কর অব্যাহতি যতটা সম্ভব পরিহার করা। অস্বাভাবিক কোনো কারণ ব্যতীত এসআরও জারি করা আমরা পরিহার করব। এর ফলে রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আসবে। সরকারের প্রতি ব্যবসায়ীদের আস্থাও বেড়ে যাবে।’ অনুরোধ জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশের অদম্য অগ্রযাত্রা টেকসই করার লক্ষ্যে, তাৎপর্যপূর্ণ এসব অনুশাসনের ভিত্তিতে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পে আমদানি শুল্ক, আয়কর ও ভ্যাট অব্যাহতির পরিবর্তে সংশ্লিষ্ট শুল্ককর খাতের হিসাব প্রাক্কলনপূর্বক অর্থ বিভাগ থেকে যথাযথ বরাদ্দ গ্রহণ করে তা নির্বাহের লক্ষ্যে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো হলো।

এনবিআর সূত্র মতে, ছোট-বড় উন্নয়ন প্রকল্প, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পে কর অব্যাহতি দিয়ে আসছে এনবিআর। এছাড়া মন্ত্রণালয়, সরকারি সংস্থা, বিভিন্ন বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে কর অব্যাহতি দেয়া হয়। অন্যদিকে বিনিয়োগ বাড়াতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত, বেজা-বেপজায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ এবং শিল্প স্থাপনে কর অব্যাহতি দেয়া হয়। দেশে শিল্প স্থাপনে বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও বছরের পর বছর অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। তবে অব্যাহতির পরিমাণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি এনবিআর অব্যাহতি বিষয়ে একটি গবেষণা করে চেয়ারম্যানকে প্রতিবেদন দিয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, প্রতি বছর এনবিআর প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব অব্যাহতি দিয়ে আসছে। খাত হিসেবে বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেশে কয়েকটি খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে মাত্র ৮ মাসে প্রায় পৌনে চার হাজার কোটি টাকা অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। খাতগুলো হলো মোটরসাইকেল, মোবাইল, কম্পিউটার, ওয়াশিং মেশিন, কম্প্রেসার, এলপিজি গ্যাস সিলিন্ডার, লিফট ও মাইক্রোবাস।

অব্যাহতির সংস্কৃতি থেকে এনবিআর বেরিয়ে আসতে চায় বলে এনবিআর চেয়ারম্যান বিভিন্ন সভায় প্রকাশ্যে বলেছে। সে অনুযায়ী আগামী বাজেটে অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরতে এনবিআর কাজ করছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, যেসব খাতে একেবারে প্রয়োজনীয়, সেসব খাত ছাড়া বাকি সব খাতে অব্যাহতি বাতিল করতে কাজ করা হচ্ছে। এই নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে আলোচনা করা হচ্ছে। হয়তো এই বাজেটে তার একটি দিকনির্দেশনা থাকবে।

এনবিআর সূত্রমতে, ২০৩১ সালে কর জিডিপি ১৭-তে নিতে হবে। অর্থাৎ ৯ বছরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতি বছর ১ শতাংশের বেশি, যা সহজ নয়। ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে উন্নীত করার জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। তবে কর অব্যাহতির লাগাম টেনে ধরতে পারলে কর জিডিপির অনুপাত ২০৩১ সালের মধ্যে ১৭-তে উন্নীত করা সম্ভব বলে মনে করেন এনবিআর সংশ্লিষ্টরা।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০