কর পরিদর্শক স্বামীর অবৈধ আয়ে কোটিপতি স্ত্রী!

নজরুল ইসলাম: কৃষিজমিকে বাইদ শ্রেণি দেখিয়ে জমি কিনে ফাঁকি দিয়েছেন সরকারের রাজস্ব। নতুন টিআইএন খুলে আয়কর নথিতে প্রতারণার আশ্রয়ে ভুয়া আয় প্রদর্শন করে বৈধ করার অপচেষ্টাও করেছেন। জিপিএফ ফান্ড ও পোলট্রি ফার্মের আয় থেকে ফ্ল্যাট কেনার দাবি করলেও বিনিয়োগের যথার্থ উৎস পাওয়া যায়নি। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে রয়েছে ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়িটির দালিলিক মূল্য ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৫ টাকা, যা তিনি গোপন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তা আর পারেননি কর পরিদর্শক আবু হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম। তিনি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপন করার প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ অভিযোগে কর কর্মকর্তা মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুদক। দুদকের গাজীপুর সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে উপপরিচালক মো. মোজাহার আলী সরদার বাদী হয়ে মামলা দুটি দাখিল করেন।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি আয়কর বিভাগে পরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন আবু হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম। ২০১৭ সালে স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে চাচাতো ভাই আব্দুর রাজ্জাক ও রাসেল মিয়া থেকে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১৫ শতাংশ জমি কেনেন। চালা বা কৃষি জমি হিসেবে এ জমির মূল্য ১৭ লাখ ২৫ হাজার ৭৯৫ টাকা। অথচ তিনি বাইদ শ্রেণি দেখিয়ে ১৫ শতাংশ জমির মূল্য ৫ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দলিল মূল্য দেখিয়ে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে মৌজা দরেই জমি কেনা হয়েছে। স্ত্রীর নামে দলিলটি কমমূল্যে রেজিস্ট্রি করায় প্রিয়ামশনের ভয়ে ওই জমি ২০১৭ সালের ১৬ এপ্রিল পুনরায় সাবকবলা দলিলে আব্দুর রাজ্জাক ও রাসেল মিয়ার কাছে হস্তান্তর দেখান। পরে ওই জমি আব্দুর রাজ্জাক ও রাসেল মিয়ার কাছ থেকে ২০১৭ সালের ৩১ মে বেল এওয়াজ দলিল করে নিজে মালিক হন। ডাচবাংলা ব্যাংক গাজীপুর চৌরাস্তা শাখায় ১ হাজার টাকা জমা দিয়ে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিসাব খোলেন। আয়কর পরিদর্শক হিসেবে চাকরি পাওয়ার পর ২০১২ সালের ১ জুলাই পর্যন্ত বেতন-ভাতা বহির্ভূত ৬৭ লাখ ৮৯ হাজার ১৫৯ টাকা জমা ও ৬৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৩৪ টাকা উত্তোলন করেন। দুদকের কাছে এটা অস্বাভাবিক, সন্দেহজনক ও অবৈধ অর্থের লেনদেন মর্মে প্রতীয়মান হয়েছে। পরে ওই হিসাব থেকে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারিতে ২১ হাজার ৪১৩ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে ডিবিবিএল শফিপুর এসএমই/এগ্রিকালচার শাখায় একটি হিসাব খোলেন।

ঢাকার উত্তরায় কর অঞ্চল-৯-এর কর পরিদর্শক থাকাকালে ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দুদক কমিশনে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন আবু হাসান মোহাম্মদ খাইরুল ইসলাম। তিনি মাত্র ২৮ লাখ ২৮ হাজার ২৭৭ টাকার অস্থাবর সম্পদের হিসাব জমা দেন। কিন্তু রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় তার নামে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ১৫ শতাংশ জমির ওপর ডুপ্লেক্স বাড়ির সন্ধান পায় দুদক। যার দালিলিক মূল্য পাওয়া যায় ১  কোটি ৩৩ লাখ ৪৪ হাজার ২৪৫ টাকা, যা তিনি গোপন করার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে তার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৩২ লাখ ১ হাজার ৮৯৮ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে নতুন টিআইএন খুলে আয়কর নথিতে প্রতারণার আশ্রয়ে অবৈধভাবে করা আয় প্রদর্শন করে বৈধ করার অপচেষ্টা চালানোর অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে।

কর পরিদর্শকের স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার নামে কালিয়াকৈরের বড়ইবাড়ী মৌজায় ১৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ২০ শতাংশ ও ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ জমির বিনিয়োগের যথার্থ উৎস পাওয়া যায়নি। ডাকুরাইল মৌজায় ১৫ শতাংশ ও ২০ শতাংশ জমিরও বিনিয়োগের যথার্থ উৎস পাওয়া যায়নি। রাজউকের সম্প্রসারিত উত্তরা আবাসিক এলাকার ১৬ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রাস্তায় ২৬ নম্বর প্লটেরও বিনিয়োগের যথার্থ উৎস পাওয়া যায়নি। উত্তরা আবাসিক এলাকার ৩/সি রোডের ৪ নম্বর প্লটে একটি ফ্ল্যাট জিপিএফ ফান্ড ও পোলট্রি ফার্মের আয় থেকে কেনা দেখালেও বিনিয়োগের উৎস যথার্থ নয়। এছাড়া বড়ইবাড়ী মৌজায় ৩৫ শতাংশ জমির বৈধ উৎস না থাকায় আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএএ ধারায় ৫৫ লাখ টাকা ভুয়াভাবে প্রদর্শন করেন। তার নামে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবে ৩২ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৯ টাকা জমা ও ৩২ লাখ ৭৬ হাজার ৫৬৪ টাকা উত্তোলন করার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ডিপোজিট হিসেবে ২০ লাখ টাকা জমা পাওয়া গেছে, যার বৈধ উৎস না থাকায় আয়কর অধ্যাদেশের ১৯এএএএএ অনুযায়ী প্রদর্শন করা হয়েছে। ডাচবাংলা ব্যাংকে সঞ্চয়ী হিসাবে ৩১ লাখ ৪ হাজার ৫৭ টাকা জমা ও ৩০ লাখ ২৮ হাজার ৩৭৫ টাকা উত্তোলন করার সন্দেহজনক ও অস্বাভাবিক অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুদক। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে থাকা ৪০ লাখ টাকারও কোনো বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় মামলায় কর পরিদর্শকের স্ত্রী লাকী রেজওয়ানার ২০২১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ১ কোটি ৪১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ টাকা সম্পদের তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রকৃতপক্ষে তিনি স্বামীর দুর্নীতির মাধ্যমে আয়ের অবৈধ উৎস আড়াল করতে সহযোগিতা করেছেন। খাইরুল ইসলাম তার আয়ের অবৈধ উৎস, প্রকৃতি, উৎস ও অবস্থান গোপন করতে তার স্ত্রী আসামি লাকী রেজওয়ানাকে ব্যবহার করে ওই গোপন করা সম্পদসহ মোট ২ কোটি ৬৮ লাখ ২৯ হাজার ৮৭৭ টাকার অবৈধ সম্পদ গড়েছেন।

লাকী দুদকে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে মোট ১ কোটি ৬৯ লাখ ৯১ হাজার ৮৮৫ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব দাখিল করেন। কিন্তু দুদকের অনুসন্ধানে ওই সম্পদের প্রকৃত হিসাব পাওয়া যায় ৩ কোটি ১১ লাখ ৯ হাজার ৫৫৬ টাকা। অর্থাৎ ১ কোটি ৪১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন করেছেন তিনি। অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধানে তার নামে ১ কোটি ২৭ লাখ ১২ হাজার ২০৬ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের প্রমাণ পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় মামলায় স্বামী ও স্ত্রী উভয়কেই আসামি করা হয়েছে।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০