কর ফাঁকিতে ‘কোকাকোলা’

রহমত রহমান: দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কোমল পানীয় কোম্পানি কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেড। বহুজাতিক এই কোম্পানির বিরুদ্ধে আয় গোপন করে কর ফাঁকি দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ২০১৯-২০ করবর্ষে দুটি খাতে প্রতিষ্ঠানটি আয় গোপনের মাধ্যমে কর পরিহার করেছে। রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেডের এমন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ‘আপত্তি’ দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল কার্যালয়ের অধীন রাজস্ব অডিট অধিদপ্তর এনবিআরের আওতাধীন ১০টি কর অঞ্চলের অধীনে ১৮টি কর সার্কেলের ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের ২০১৯-২০ করবর্ষের (২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত) ওপর আয়কর নির্ধারণের সঠিকতা যাচাইয়ের ওপর অডিট ইন্সপেকশন রিপোর্ট (এআইআর) সম্পন্ন করেছে, যার মধ্যে কোকাকোলার অনিয়ম উঠে এসেছে। কোকাকোলা কর অঞ্চল-৪, ঢাকার অধীন ৬৭ কর সার্কেলের (কোম্পানিজ) করদাতা প্রতিষ্ঠান।

অডিট অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেড ২০১৯-২০ করবর্ষে রিটার্নে আয় দেখিয়েছে এক কোটি ৭৪ লাখ পাঁচ হাজার ৬১০ টাকা। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সপেনসিভ’ খাতে ‘এন্টারটেইনমেন্ট’ হিসেবে ১২ লাখ ২২ হাজার ৭৪ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশ ও আয়কর বিধিমালা অনুযায়ী কোম্পানির প্রর্দশিত মোট আয় এক কোটি ৭৪ লাখ পাঁচ হাজার ৬১০ টাকার ওপর আপ্যায়ন খরচ বাবদ অনুমোদনযোগ্য প্রথম ১০ লাখ টাকার ওপর চার শতাংশ হারে ৪০ হাজার টাকা এবং অবশিষ্ট এক কোটি ৬৪ লাখ পাঁচ হাজার ৬১০ টাকার ওপর দুই শতাংশ হারে তিন লাখ ২৮ হাজার ১১২ টাকাসহ মোট তিন লাখ ৬৮ হাজার ১১২ টাকা প্রাপ্য। ফলে আপ্যায়ন খাতে অতিরিক্ত দাবি করা খরচ আট লাখ ৫৩ হাজার ৯৬২ টাকা, যা অন্যান্য উৎস থেকে আয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ এক্সপেনসিভ’ হেডে ‘ট্রাভেল অ্যান্ড লোডিং’ হিসেবে এক কোটি ১০ লাখ চার হাজার ৭৫২ টাকা খরচ দাবি করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ‘ওভারসিজ ট্রাভেলিং এক্সপেন্স’ বাবদ ৫৫ লাখ ১০ হাজার ৫৪৩ টাকা। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী ‘ওভারসিস ট্রাভেলিং’ বাবদ কোম্পানি কর্তৃক ঘোষিত মোট টার্নওভার ১০ কোটি ৫৪ লাখ ২৬ হাজার ৯১৭ টাকার ১ দশমিক ২৫ শতাংশ হারে ১৩ লাখ ১৭ হাজার ৮৩৬ টাকা প্রাপ্য। ফলে এই খাতে অতিরিক্ত দাবি করা খরচ ৪১ লাখ ৯২ হাজার ৭০৭ টাকা, যা অন্যান্য উৎস থেকে আয় হিসেবে মোট আয়ের সঙ্গে যোগযোগ্য।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই করবর্ষে কোকাকোলা আয় দেখিয়েছে এক কোটি ৭৪ লাখ পাঁচ হাজার ৬১০ টাকা। অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় কোম্পানির মোট আয় পেয়েছে দুই কোটি ২৪ লাখ ৫২ হাজার ২৭৯ টাকা। প্রতিষ্ঠান আয় গোপন করেছে ৫০ লাখ ৪৬ হাজার ৬৬৯ টাকা। ওই আয়ের ওপর ৩৫ শতাংশ হারে আয়কর প্রযোজ্য। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি ওই করবর্ষে ১৭ লাখ ৬৬ হাজার ৩৩৪ টাকা আয়কর ফাঁকি দিয়েছে। করদাতা কোম্পানি ৮২ বিবি ধারায় রিটার্ন দাখিল করায় অনিয়মের বিষয়টি পরীক্ষা করে পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অডিট অধিদপ্তরকে জানাতে বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে এনবিআরের আয়কর বিভাগের একজন কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কোকাকোলার বিরুদ্ধে অডিট অধিদপ্তর আয় গোপনের যে আপত্তি দিয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। কর অঞ্চলের যে সার্কেলে কোম্পানির রিটার্ন রয়েছে, তারা তা খতিয়ে দেখবে। এই খাতে আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান কর কর্তন না করলে কর দিতে হবে। সঙ্গে আয় গোপনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ তবে বহুজাতিক কোকাকোলার কর ফাঁকিতে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাপস কুমার মণ্ডলের ব্যক্তিগত ফোন নম্বরে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। বক্তব্যের বিষয় লিখে দেয়া হলে তিনি সিন করেন। পরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পক্ষে যোগাযোগ করেন কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেডের কান্ট্রি পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, কমিউনিকেশনস অ্যান্ড সাস্টেনিবিলিটি লিড ফারাহ শারমিন আওলাদ। তিনি বক্তব্যের বিষয় ই-মেইলে পাঠানোর পরামর্শ দেন। পরে অভিযোগের বিষয়ে কোকাকোলার পক্ষ থেকে ই-মেইলে পাঠানো বক্তব্যে বলা হয়, ‘কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেড বাংলাদেশের প্রতিটি নিয়মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। পাশাপাশি নৈতিকতার উচ্চমান ও কঠোর কমপ্লায়েন্স নীতি বজায় রাখতে নিয়মবহির্ভূত কোনো বিচ্যুতি বা অসংগতির ক্ষেত্রে কোকাকোলা শূন্য-সহনশীলতা নীতি প্রদর্শন করে।’

উল্লেখ্য, কোকাকোলা পাঁচ দশকের বেশি সময় বাংলাদেশে ব্যবসা করছে। কৌশলগত দিক থেকেও দেশটি কোকাকোলার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ইউনিটের সমন্বয়ে বাংলাদেশে দ্য কোকাকোলা সিস্টেম গঠিত। ইউনিটগুলো যথাক্রমে কোকাকোলা বাংলাদেশ লিমিটেড (সিসিবিএল), ইন্টারন্যাশনাল বেভারেজ প্রাইভেট লিমিটেড (আইবিপিএল) এবং আব্দুল মোনেম লিমিটেড (এএমএল)। নিজস্ব প্ল্যান্ট দুটির পাশাপাশি বোতলজাতকরণ ও সরবরাহ কার্যক্রমে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবদান রাখছে কোকাকোলা। কোকাকোলা বাংলাদেশের মূল পণ্য কোকাকোলা, ডায়েট কোক, স্প্রাইট, ফান্টা, কিনলে পানি, কিনলে সোডা, কোকাকোলা জিরো, স্প্রাইট জিরো, থাম্বস আপ কারেন্ট  প্রভৃতি।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০