কর-বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে

রেজাউল করিম খোকন: দেশের অর্থনীতি বড় হচ্ছে। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না রাজস্ব আহরণ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনও ১০ শতাংশের ঘরে। সরকারের রাজস্বের ৭০ শতাংশই আসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও শুল্কের মতো পরোক্ষ খাত থেকে। প্রত্যক্ষ কর থেকে আসে বাকি ৩০ শতাংশ। আবার প্রত্যক্ষ করের ৮৫ শতাংশই আসে উৎসে কর কর্তন ও অগ্রিম কর থেকে। মূলত দেশের মানুষের বড় একটা অংশ করজালের বাইরে থাকায় তাদের কাছ থেকে রিটার্নের ভিত্তিতে আয়কর আহরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া আয়কর আহরণ ও আদায় পদ্ধতি ঝামেলাপূর্ণ হওয়ায় করদাতারাও আয়কর প্রদানে খুব একটা আগ্রহী নন। ফলে ব্যয় মেটাতে পরোক্ষ করের ওপর নির্ভর করতে হয় সরকারকে। আর প্রত্যক্ষ কর যেটুকু আহরণ হয়, তা-ও অনেকাংশে উৎসে কর্তননির্ভর। উৎসে কর কর্তন বা টিডিএস হচ্ছে দেশের জনগণের কাছ থেকে আয়ের বিভিন্ন উৎস ও সেবা প্রদান পর্যায়ে কর আদায় করার পরোক্ষ উপায়। বেতন ছাড়াও কমিশন, ব্রোকারেজ, রয়্যালটি পেমেন্ট, চুক্তির ভিত্তিতে পরিশোধ, একাধিক আর্থিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আয়কৃত সুদ বা মুনাফা, পেশাগত ফি ইত্যাদির ক্ষেত্রে এ কর কর্তন প্রযোজ্য হয়।

রাজস্ব আয় প্রত্যাশার চেয়ে কম হচ্ছে। তাই সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য বাড়িয়ে কর-বহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ক্ষেত্রে গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, এমন সেবার মাশুল বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান তিনটি উৎস হচ্ছে- আয়কর, মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) ও শুল্ক। এ উৎসগুলো থেকে আয় সংগ্রহের দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। এর বাইরেও অন্যতম একটি খাত রয়েছে সরকারের রাজস্ব আয় সংগ্রহের, যেটাকে সরকার বলে করবহির্ভূত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ)। সংক্ষেপে তা এনটিআর নামে পরিচিত। সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে ইতোমধ্যে ব্যয় সাশ্রয়ের পাশাপাশি আরও কাটছাঁটের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে সরকারি ব্যয় নির্বাহে যতটা সম্ভব কম ঋণ নেয়া হবে। নিজস্ব প্রয়োজন তো আছেই, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দিক থেকেও রাজস্ব আয় বাড়ানোর চাপ রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব সংগ্রহের হার ৮ শতাংশের কম। আইএমএফ বলে দিয়েছে, বাংলাদেশকে রাজস্ব-জিডিপির হার বছরে দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা এবং সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সরকার ঋণ দিলেও তার বিপরীতে সুদ পাওয়া যায় না। তাই গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ খাত থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও আয় হয়েছে মাত্র ২ হাজার কোটি টাকা।

সরকারি বিভিন্ন পরিষেবায় ৮ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৬ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া ভাড়া ও ইজারায় ২ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ১ হাজার ৮০০, টোলে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বিপরীতে ১ হাজার ২০০ কোটি এবং অবাণিজ্যিক বিক্রয় কার্যক্রম বাবদ ৪ হাজার কোটির বিপরীতে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। তবে লভ্যাংশ, জরিমানা ও অন্যান্য রাজস্ব খাতে আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছু বেশি হয়েছে। এনটিআর আদায় বাড়াতে ইতোমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় আলোচনা করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে— এক বছরে ৩১টি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে ৯টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ২০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতায় ৭৭০টি এনটিআর আইটেমে রেইট হালনাগাদ করা হয়েছে। এ রাজস্ব আহরণে সচেতনতা ও সংবেদনশীলতা বাড়ানোর লক্ষ্যে খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট বিভাগে বিভাগীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এছাড়া সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তর, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রযোজ্য করবহির্ভূত রাজস্ববিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ তথ্যভান্ডার তৈরির কাজ চলমান। জেলা প্রশাসনসহ মাঠ প্রশাসনের দপ্তরগুলোর বিভিন্ন খাতে দীর্ঘদিন ধরে অব্যয়িত অবস্থায় থাকা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা প্রদানের উদ্যোগ নেয়ার পাশাপাশি এনটিআর রাজস্ব সংক্রান্ত গাইডলাইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে।

আদায়সংক্রান্ত নির্দেশনায় বলা হয়, সরকারি পরিষেবাগুলোর মাশুল তিন বছর পরপর যৌক্তিক হারে বাড়িয়ে হালনাগাদ করতে হবে। সরকারি কোষাগারে অর্থ প্রদানে আবশ্যিকভাবে এ চালানের ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে আদায় করা রাজস্ব যথাসময়ে হিসাবভুক্ত করা হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত করতে হবে। ইক্যুইটি গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের এজিএম বা বোর্ডসভায় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত মূলধনের বিপরীতে লভ্যাংশ প্রদান নিশ্চিত করে অর্থ বিভাগকে জানাতে হবে। একই সঙ্গে বছর শেষে ব্যাংক হিসাবে অব্যয়িত অর্থ পড়ে থাকলে তা সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হবে।

উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোতে করবহির্ভূত আয় সরকারি আয়ের একটি প্রধান উৎস। চীনের মোট রাজস্বের ৪০ শতাংশ হচ্ছে কর-বহির্ভূত আয়। মালয়েশিয়ায় যা ২৭ শতাংশ। এমনকি ছোট অর্থনীতির দেশ ভুটানে তা ২৮ শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এটি ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। অবশ্য বাংলাদেশেও কোনো কোনো সময় করবহির্ভূত রাজস্ব বেড়েছে। যেমন ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে তা বেড়েছিল মোবাইল অপারেটরদের কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার স্পেকট্রাম বিক্রি এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে জমে থাকা বাড়তি তহবিল ফেরত নেয়ায়। ওই দুই অর্থবছরে এনটিআর থেকে রাজস্ব আসে প্রায় ১ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ওই দুই ধরনের আয় সব বছরেই হয় না। এজন্য অর্থ মন্ত্রণালয় অন্য সব মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। আবার দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। ফলে এনটিআর সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা এবং সেবা প্রদানে উন্নতি না করতে পারলে শুধু দাম বাড়িয়ে কর ব্যতীত আয় তেমন বাড়বে না। সরকারি সেবার ফি ও চার্জ বাড়ানোর ফলে জনসাধারণের খরচই কেবল বাড়বে। ইতোমধ্যেই জমি ও গাড়ির নিবন্ধন বা পাসপোর্টের মতো সেবা নিতে বেশ অর্থ গুনতে হচ্ছে। সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কমই রয়ে গেছে কর-বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয়।

জাতীয় বাজেটে কর-বহির্ভূত এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা তুলনামূলক কম দেয়া হয়। অথচ এসব খাত থেকে রাজস্ব বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক করে এখান থেকে বড় অঙ্কের রাজস্ব আহরণের সুযোগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে আয় বাড়াতে হবে। সরকারি ব্যয় নির্বাহের ক্ষেত্রে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে বাড়তি লভ্যাংশ পাওয়া গেলে এনবিআরের ওপর লক্ষ্যমাত্রা কমবে। এতে জনগণের ওপরও করের বোঝা কমার সুযোগ আসবে। এ বিষয়গুলোতে আরও নজর দিতে হবে। এনটিআর থেকে ভালো রাজস্ব সংগ্রহের বিষয়ে অর্থ বিভাগ কয়েক বছর ধরে কাজ করলেও ভালো ফল পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে সংস্থাগুলোর যেমন অসহযোগিতা আছে, মন্ত্রণালয়গুলোও তেমন তৎপর নয়। মন্ত্রণালয়গুলো শুধু অর্থ নিতে চায়, অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে আগ্রহ কম। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মূল বাজেটে এনটিআর থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সরকার। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪৯ হাজার কোটি টাকা করা হলেও প্রকৃত আয় হয় ৩৯ হাজার ২৫৫ কোটি টাকা। এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয় ৩৮ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে এ খাত থেকে রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।

বিভিন্ন টোল ও মাশুল বৃদ্ধির অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা করেছে অর্থ বিভাগ। মাশুল বাড়াতে অধিদপ্তর ও পরিদপ্তরগুলোকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে জানানো হয়েছে, তারা যেন এনটিআর বাড়ানোর প্রস্তুতি নেয়। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে- বাণিজ্য, ভূমি, প্রাণিসম্পদ, রেলপথ, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ইত্যাদি। কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও দপ্তর এরই মধ্যে কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো কোনো দপ্তরের মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এনটিআরের মধ্যে বড় ১০টি উৎস রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম লভ্যাংশ ও মুনাফা। ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের বিপরীতে সরকার লভ্যাংশ ও মুনাফা পায়। আইন ও নিয়মনীতির পরিপন্থি বিভিন্ন কাজের জন্য সরকার জরিমানা, দণ্ড ও বাজেয়াপ্তকরণ করে প্রতিবছর কিছু অর্থ আয় করে। সরকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনগণকে দেয়া সেবার বিপরীতে আয় করে। যেমন, আমদানি-রপ্তানি সনদের মাশুল, কোম্পানি নিবন্ধন মাশুল, বীমা প্রিমিয়াম, সমবায় সমিতিগুলোর নিরীক্ষা মাশুল, নিবন্ধন ও নবায়ন মাশুল ইত্যাদি। সঙ্গে আছে মূলধন রাজস্ব। পুরোনো গাড়ি বা আসবাব নিলামে বিক্রির অর্থ মূলধন রাজস্ব হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজস্ব আয়ে প্রত্যাশার চেয়ে হচ্ছে কম প্রবৃদ্ধি। এরই মধ্যে সরকারি বিভিন্ন সেবার ফি ও মূল্য প্রদান বাড়িয়ে কর-বহির্ভূত উৎস থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজছে অর্থ মন্ত্রণালয়। আগামী অর্থবছরে সরকারের আয় ও ব্যয়ের ব্যবধান কমিয়ে আনতেই এমন পরিকল্পনা।

যেসব সেবার ফি গত তিন বছরে পরিবর্তন হয়নি, সেগুলো বাড়িয়ে নতুন করে নির্ধারণ করতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সে অনুসারে, ইতোমধ্যে কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জনগণকে দেওয়া তাদের সেবার ফি ও চার্জ পুনর্নির্ধারণে কমিটিও গঠন করেছে। কিছু বিভাগ প্রায় এক দশক ধরে তাদের সেবা মূল্য বা ফি বাড়ায়নি। আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) তারা এটি সংশোধন করলে জনসাধারণ, ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের বেশি খরচ করতে হবে। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ড, আমানতের সুদ, সেবামূল্য ও অন্যান্য চার্জ থেকে কর-বহির্ভূত আয় হয়, যা কর রাজস্বের পর সরকারের আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। কিন্তু এটি মোট বার্ষিক রাজস্বের ১০ ভাগের ১ ভাগের সামান্য বেশি, যা অন্যান্য উন্নয়নশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির দেশের তুলনায় অনেকটাই কম। সরকারের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সক্ষমতা এবং সেবা প্রদানের উন্নতি না করতে পারলে- শুধু মূল্য বাড়িয়ে কর-ব্যতীত আয় তেমন বাড়বে না। অন্যথায়, সরকারি সেবার ফি ও চার্জ বাড়ানোর ফলে জনসাধারণের খরচই কেবল বাড়বে; এরই মধ্যে যাদের জমি ও গাড়ির গাড়ির নিবন্ধন বা পাসপোর্টের মতো সেবা নিতে বেশ বড় ‘উপরি’ মূল্যও চুকাতে হচ্ছে।

সম্ভাবনার চেয়ে অনেক কমই রয়ে গেছে কর-বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয়। জাতীয় বাজেটে কর-বহির্ভূত এবং নন-এনবিআর উৎস থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হলেও, আরও বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর রাজস্ব অর্জনের জন্য মূলত এনবিআরের ওপরই সব মনোযোগ দেয়া হয়। কর-বহির্ভূত আয়ের অংশ-সরকারি প্রতিষ্ঠানের ডিভিডেন্ট, আমানতের সুদ, সেবামূল্য থেকে আয় বাংলাদেশে ১১ শতাংশের মধ্যে আটকে থাকছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে ফি ও সেবামূল্য থেকে আয় বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেছে। এরই প্রতিক্রিয়ায় সরকারের বিভিন্ন বিভাগ তাদের সেবামূল্য বাড়ায়, এতে সরকারি সেবা পেতে জনগণের ব্যয় বাড়লেও কর-বহির্ভূত আয় বাড়াতে সামান্যই ভূমিকা রাখে। এ কারণে প্রতি অর্থবছরেই কর-বহির্ভূত রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা হ্রাস করা হয়। গতবছরও সরকারের বিভিন্ন পার্কে প্রবেশ ফি, হাসপাতালের আউটডোরে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার টিকিটের ফি, বিভিন্ন যানবাহনের জন্য সেতুগুলোর টোলের পরিমাণ বাড়ানোসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরপরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এ খাতের রাজস্ব সংগ্রহ হবে না। সেবার মান উন্নত করার পাশাপাশি, দুর্নীতি বা অনিয়ম রোধ করা গেলে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সেবা থেকে আয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সরকারি ফি ও সেবামূল্য দেখতে কম মনে হলেও সেবা গ্রহীতাদের তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি খরচ করতে হয়।

কর-বহির্ভূত আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো- যাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, ক্রমাগত লোকসানের ধারাবাহিকতা থেকে বেরিয়ে এসে ও আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে। আবার দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে মানুষের ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সেবা গ্রহণের হার বেড়েছে। ফলে নন ট্যাক্স রেভিনিউ সংগ্রহ বাড়বে বলে আশা করা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেবা মূল্য বাড়ানো ও নতুন ফি বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবার মান উন্নত না হওয়া, নতুন উৎস চিহ্নিত না হওয়া এবং অনিয়মের কারণে কর-বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ছে না। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো দেশ উন্নত সেবা নিশ্চিত করে এই খাত থেকে রাজস্ব সংগ্রহ করছে। কর-বহির্ভূত রাজস্বে সর্বোচ্চ অবদান রাখে সুদ আয়, তারপরেই আছে প্রশাসনিক বিভিন্ন ফি, ডিভিডেন্ট ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর আমানতের সুদ আয় এবং সরকারি সম্পত্তি ভাড়া বা ইজারার মাধ্যমে পাওয়া আয়। সরকারি সম্পত্তি লিজ (ইজারা) দেয়ার পদ্ধতি আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রতিযোগিতার অভাবে সরকার ন্যায্যমূল্য পায় না। একইসঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে, যা ব্যয় কমিয়ে এনে এসব প্রতিষ্ঠান আরও বেশি আয় করতে পারে। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় সংস্থার সেবা দেয়ার দক্ষতা আরও বাড়াতে হবে, যাতে মানুষ বেশি সেবা গ্রহণ ও ফি আদায় স্বচ্ছ হয়। রাজস্ব আহরণে হিস্যার দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকলেও প্রত্যক্ষ কর আহরণেই সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে সরকারের। দেশের রাজস্ব ব্যবস্থায় নানা অসামঞ্জস্য রয়েছে। তা দূর করতে হবে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। হাতে সময় নেই তেমন। এর মধ্যে রেভিনিউ রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক, ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক সবই স্ট্রিমলাইন করতে হবে। রাজস্বের রেগুলেটরি কাঠামো যত দ্রুত সম্ভব হালনাগাদ করা প্রয়োজন।

 

আর্কাইভ

রবি সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি
১০১১১২১৩১৪
১৫১৬১৭১৮১৯২০২১
২২২৩২৪২৫২৬২৭২৮
২৯৩০