মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: কর সুবিধা নিতে পুঁজিবাজারকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে বিভিন্ন দুর্বল কোম্পানি। এতে বাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা বাড়লেও তা বাজারে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারছে না। অন্যদিকে বাজারে এসেই বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ভুলে যাচ্ছে এসব দুর্বল কোম্পানি। শেয়ার ছাড়ার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পর বিনিয়োগকারীদের নিরাশ করছে এসব কোম্পানি। বিনিয়োগকারীদের রিটার্ন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে নামমাত্র লভ্যাংশ। কয়েক বছর না যেতেই কিছু কোম্পানির অবস্থান হচ্ছে ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে। এতে দুর্বল কোম্পানির তালিকা আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
পুঁজিবাজারে মোট ১৯ খাতের কোম্পানি রয়েছে (বন্ড ও ডিবেঞ্চার বাদে)। এর মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, সিরামিক, প্রকৌশল, খাদ্য, আইটি, কাগজ ও প্রকাশনাসহ অন্যান্য খাতের কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার সুবাধে ১০ শতাংশ কর রেয়াতে সুবিধা পাচ্ছে। অর্থাৎ এসব কোম্পানির করপোরেট কর পরিশোধ করতে হচ্ছে ২৫ শতাংশ, অন্য কোম্পানির ক্ষেত্রে যা ৩৫ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি এই সুবিধা পেয়ে থাকে। অন্যদিকে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও বিমার ক্ষেত্রে কর দিতে হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। তালিকাভুক্ত না হলে তাদের কর পরিশোধ করতে হয় ৪০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, মূলত কম কর দেওয়ার সুবিধা নিতেই পুঁজিবাজারে আসে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। তাদের উদ্দেশ্য থাকে সরকার ও বিনিয়োগকারীদের ফাঁকি দেওয়া, যে কারণে নতুন নতুন কোম্পানির আগমন ঘটলেও ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। দীর্ঘ সময় বাজারে আসছে না বহুজাতিক কিংবা ভালো মানের কোম্পানি। যে কোম্পানিগুলো পুঁজিবাজারে আসছে সেগুলোর আর্থিক ভিত্তি তুলনামূলকভাবে দুর্বল। পুঁজিবাজারের স্বার্থে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির তালিকাভুক্তির সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন বাজারসংশ্লিষ্টরা।
এক পরিসংখ্যনে দেখা যায়, গত দুই বছরে বাজারের যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ‘এ’ ক্যাটেগরিতে থাকার জন্য ১০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দিয়েছে। অন্যদিকে গত পাঁচ বছরে যেসব কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে তাদের মধ্যে বর্তমানে ছয়টি প্রতিষ্ঠান ‘জেড’ ক্যাটেগরিতে অবস্থান করছে। গত পাঁচ বছরে (২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল) তালিকাভুক্ত হওয়ার পর ছয়টি কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বাজারে আসতে না আসতেই কোম্পানিগুলোর অবস্থান হয়েছে জেড ক্যাটেগরিতে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মিউচুয়াল ফান্ড বাদে বিভিন্ন খাতের মোট ৫১টি প্রতিষ্ঠান পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। এ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়েছে ২০১৪ সালে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এ সময় মোট ১৭টি কোম্পানির অনুমোদন দেয়। ২০১৫ সালেও ১৩টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন পায়। একইভাবে ২০১৩ সালে মোট অনুমোদন পায় ১৫টি কোম্পানির আইপিও। অন্যদিকে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বিএসইসি ছয়টি করে নতুন কোম্পানি পুঁজিবাজারে আসার অনুমোদন দেয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্বল কোম্পানি এসেছে ২০১৪ সালে। এই সময় পুঁজিবাজারে আসা ১৭ কোম্পানির মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান জেড ক্যাটেগরিতে চলে যায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑসুহƒদ ইন্ডাস্ট্রিজ, তুংহাই নিটিং, খুলনা প্রিন্টিং ও এমারাল্ড অয়েল। আর ২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে অভিষেক হওয়া সান লাইফ ইন্স্যুরেন্স জেড ক্যাটেগরিতে চলে যায়। এছাড়া ২০১৫ সালে অনুমোদন পাওয়া সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল লভ্যাংশ না দিতে পারায় জেড ক্যাটেগরিতে চলে গেছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, কোম্পানিগুলো যখন বাজারে আসতে চায় তখন ইস্যু ম্যানেজার থেকে শুরু করে অডিটরসহ সংশ্লিষ্ট সবাই কোম্পানির আর্থিক অবস্থার একটি সুন্দর বিবরণ উপস্থান করে। বিএসইসির উচিত, এটা ভালো করে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া। যদি কোনো কোম্পানির আর্থিক অবস্থা দুর্বল মনে হয় তাহলে বিনিয়োগকারীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ওই কোম্পানির অনুমোদন বন্ধ রাখা উচিত।
একই প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে ভালো শোয়ারের জোগান দিতে হলে বহুজাতিক কোম্পানিসহ ভালো ভালো কোম্পানি নিয়ে আসতে হবে। কারণ বেশিরভাগ ছোট ছোট কোম্পানিতে সমস্যা বেশি থাকে। এখান থেকে বিনিয়োগকারীরা প্রতারিত হনও বেশি।