আমি ভ্রমণপ্রিয় মানুষ। সময় ও সুযোগের মিলন হলে বেরিয়ে পড়ি। বাংলাদেশের প্রায় সব ট্যুরিস্ট স্পটে ঘুরে বেড়িয়েছি। চিন্তা করছিলাম দেশের বাইরে যাওয়ার। সব মিলিয়ে ভারত ভ্রমণটাই সবচেয়ে ভালো মনে হলো। পাসপোর্ট, ভিসা, ট্রাভেল ট্যাক্সসহ সব লিগ্যাল ডকুমেন্টস প্রস্তুত করলাম। ঈদের পর বিশাল ছুটি থাকায় ট্যুর প্ল্যান করতে কোনো সমস্যা হয়নি। আমরা ছয়জনের গ্রুপ মোটামুটি ১১ হাজার রুপিতে ১২ দিনের এ ট্যুর সম্পন্ন করি। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম গত ১৮ জুন। আজ আপনাদের শোনাব সেই ট্যুরের ২৪, ২৫ ও ২৬ জুনের গল্প!
সপ্তম দিন (২৪ জুন) রোথাং পাস ভ্রমণ
সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ি আমরা। আগেই গাড়ি রিজার্ভ করে রেখেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে গাড়িটি পাহাড়ে চড়া শুরু করে। সময় গড়ায়। আমরা উপরে উঠতে থাকি। পথিমধ্যে এক জায়গা থেকে বরফে টিকে থাকার জন্য পোশাক ভাড়া করি। আবার গাড়িতে চড়ে পৌঁছাই সোলাং ভ্যালিতে। জুন-জুলাই ছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এত বরফ পড়ে যে রোথাং পাসের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তখন এ সোলাং ভ্যালিতেই বরফ পড়ে।
মাত্র দেড় মাস খোলা থাকে বলে রোথাং পাসের রাস্তায় প্রচণ্ড ভিড় চোখে পড়ে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রচুর পর্যটক বেড়াতে এসেছেন। এমন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি রাস্তায়ও অনেক পর্যটক মোটরসাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দুই-তিনজন সাইক্লিস্টসেরও দেখা পাই। রাস্তায় দীর্ঘ জ্যামে পড়ি আমরা হাজার হাজার গাড়ি রোথাং পাসের রাস্তায়। মনে হচ্ছিল, ভারতের সব মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এখানে।
গতকাল দূর পাহাড়ের চূড়ায় জমে থাকা যে বরফ দেখেছিলাম আজ তার কাছাকাছি চলে এসেছি। ধীরে ধীরে পাহাড়ের চূড়ায় উঠছি। এখন বেশ কাছে থেকেই বরফ দেখতে পাচ্ছি। দূরে অনেক নিচে দেখা যাচ্ছে মানালি শহরটি।
অবশেষে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফিট উচ্চতায় রোথাং পাসে পৌঁছাই। চারদিকে বরফ আর বরফ। হাত দিয়ে একদলা বরফ ছুঁয়ে দেখি। বেশ ভালো লাগছিল। অনেক মানুষ এসেছেন এখানে। আমরা বরফে সøাইডিং করি। আনন্দে স্নো বল বানিয়ে একে অপরের দিকে ছুড়ে মারি।
এর মধ্যে ঠিক মাথার উপরেই মেঘ ঘনিয়ে আসে। শুরু হলো বৃষ্টি। ঠাণ্ডায় কাঁপন ধরে গিয়েছিল। তাই গাড়িতে উঠে পড়ি। বৃষ্টির মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে দিতে বলি। পুরোটা জায়গা মেঘে ঢাকা থাকায় আশপাশের কিছু দেখা যাচ্ছিল না। গাড়িগুলো হেডলাইট জ্বালিয়ে খুব সতর্কতার সঙ্গে চলছিল। ফিরতি পথে মেঘ ঘিরে ধরল আমাদের। ডানে বরফ, বাঁয়ে পাহাড়ি খাদ আর সামনে মেঘে ঢাকা রাস্তা।
রোথাং পাসে আসার পথে আমরা পাহাড়ের এক রূপ দেখেছিলাম। এখন ফেরার পথে আরেক রূপ দেখতে পাই। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি থেকে নেমে চা পান করি। হালকা নাশতা করি। হঠাৎ চোখের সামনে অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য দেখতে পাই চোখের সামনে মেঘ জমতে দেখি। বিমোহিত হয়ে পড়ি। মনে হচ্ছিল, মেঘেরা গ্রাস করে ফেলেছে আস্ত এক পাহাড়! এভাবে চলতে চলতে মানালি পৌঁছাই। ততক্ষণে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। হোটেলের রুমে খাবার নিয়ে আসি।
অষ্টম দিন (২৫ জুন) দিল্লি যাত্রা
আমি ঘুম থেকে উঠি ১১টায়। বাইরে বৃষ্টির মধ্যেই সকালটুকু যে যার মতো ঘুরে বেড়ায়। আমি কম্বল গায়ে জড়িয়ে আরাম করে শুয়ে ভারতের নানা চ্যানেল দেখে সময় কাটাই। পরে গোসল সেরে প্রস্তত হয়ে নিই। দুপুরের খাবার সেরে মল রোডের পাশের বাসস্ট্যান্ডে চলে যাই। ৩টা ২০ মিনিটে দিল্লির উদ্দেশে আমাদের বাস ছাড়ে। একটু ঠাণ্ডা অনুভূত হওয়ায় ওষুধ খেয়েছিলাম। ফলে বাসের সিটে হেলান দিয়ে মরার মতো ঘুমাই। মাঝে কিছুক্ষণের জন্য হুশ ফিরে এলে বাইরে তাকিয়ে দেখি মানালি থেকে কুল্লু-মান্ডির রাস্তায় এসে পড়েছি আমরা। বিয়াস নদীর তীর ঘেঁষে দুই পাহাড়ের মাঝের গিরিখাতে বাস ছুটে চলেছে। যত নামতে থাকি ততই নদীর প্রশস্ততা আর স্রোত বাড়তে থাকল। মাঝখানে একটা পাহাড়ের ভেতর টানেল পার হই। আমি আবারও ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুম ভাঙল রাতে। একটা রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য কিছুক্ষণের জন্য থামে আমাদের বাস। হঠাৎ ঠাণ্ডা থেকে যেন গরম আবহাওয়ায় চলে এসেছি। খাবারের দাম না জানি কেমন হয়! সেই চিন্তা থেকে ভয়ে ভয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখি মাত্র ৭০ রুপিতে ব্যুফে দিচ্ছে এতে রয়েছে আনলিমিটেড রুটি, সবজি, ভাত প্রভৃতি।
নবম দিন (২৬ জুন) দিল্লি ভ্রমণ
ভোরে পৌঁছাই দিল্লিতে। প্রথমেই নয়াদিল্লি রেলস্টেশনে কলকাতার টিকিট কাটতে গেলাম। আগ্রা-কলকাতা টিকিট কেটে চলে আসি জামে মসজিদ (মসজিদ-ই জাহান-নুমা) এলাকায়। হোটেল খুঁজে একটা রুম নিলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম। দুপুরে জামে মসজিদে নামাজ পড়ি। মসজিদ প্রাচীন ও সুন্দর।
সেখান থেকে হেঁটে গেলাম রেড ফোর্ট তথা লাল কেল্লায়। দিল্লিতে তখন ৪১ ডিগ্রি তাপমাত্রা। স্বর্গের মতো বরফ এলাকা ছেড়ে যেন নরকে এসে পড়েছি। রোদে ঝলসে কাবাব হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এর মধ্যেই লাল কেল্লায় ঢুকলাম। বিশাল এক দুর্গ এ লাল কেল্লা। এর ভেতরেও অনেক বড় স্থাপনা রয়েছে। এখান থেকে বের হয়ে উবারে চড়ে গেলাম ইন্ডিয়া গেটে। সন্ধ্যা হতেই এ গেটের আলোকসজ্জা পুরো জায়গাটিকে মনোমুগ্ধকর করে তোলে।
দিল্লির রাস্তাঘাট ঘুরে আমরা আবার জামে মসজিদ এলাকায় ফিরে আসি। এখানে কেজিদরে বিরিয়ানি বিক্রি করা হয়। ৭০ রুপিতে হাফ কেজি খাসির বিরিয়ানি কিনি। (চলবে)
সালমান রহমান পিয়াল