ফয়সাল করিম: রাজনীতির ময়দানে ‘কল্পকাহিনি’ একটি কৌশলগত উপাদান। শাসনব্যবস্থা হিসেবে সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, গণতন্ত্র যা-ই থাকুক না কেন, শক্তিশালী কল্পকাহিনি তৈরি করতে পারাটা অন্যতম রাজনৈতিক সক্ষমতা বলা যায়। সরল কথায়, যে রাজনৈতিক দল যত সুদক্ষভাবে কল্পকাহিনি তৈরি করতে পারে রাজনীতির কূটচালে সে দলটি ততটা সফলভাবে নিজের অবস্থান প্রোথিত করতে পারে। পার্শ^বর্তী দেশ ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির টানা নির্বাচনী সাফল্যের পেছনে যে ‘মুসলিমবিরোধী’ কল্পকাহিনি বড় অবদান রেখেছে; তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মুসলিম সম্প্রদায়কে ভারতে বহিরাগত সাব্যস্তকরণ এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিভাবকরূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠাকরণে বিজেপি বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে।
যদিও তাদের সে বয়ান এখন অনেকাংশেই ম্লান হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ কল্পকাহিনি নির্ভর একটি দল। বলতে দ্বিধা নেই, এক্ষেত্রে দলটি বেশ সিদ্ধহস্তও বটে। ইতিহাসের নির্মম সত্য এই যে, আওয়ামী লীগ প্রকৃতিগতভাবেই সন্ত্রাসনির্ভর। সন্ত্রাসকে রাজনৈতিক বয়ান দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা প্রাচীন রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালে জš§ নেয়া আওয়ামী লীগের (তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ) হাল ধরেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মূলত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থবিরোধী কিছু নীতির ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন এবং পরবর্তী সময় আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে যাত্রা শুরু করা দলটিতে অচিরেই অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য দেখা যায় এবং মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন।
ঘটনাক্রমে দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময়েই ব্রিটিশ শাসন-পরবর্তী সময়ের অন্যতম কলঙ্কজনক ঘটনাটি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধীদল কৃষক-শ্রমিক পার্টির মধ্যকার একটি দ্বন্দ্ব রূপ নেয় হানাহানিতে। ফলে প্রাণ হারান সংসদের স্পিকার, প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ শাহেদ আলী পাটোয়ারী। এই হত্যাকাণ্ড পরের বছরগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে বড় প্রভাব রাখে। বলাবাহুল্য, এই হত্যাকাণ্ডের জের ধরেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা দেশে শাসন জারি করেন। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক যাত্রা স্থিমিত হয়ে যায়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে বহুলচর্চিত এই ঘটনায় কৃষক-শ্রমিক পার্টি বহুলাংশে দায়ী হলেও সমসাময়িক অনেক রাজনীতিক, সাংবাদিক ঘটনাকে আরো উসকে দেয়ার অভিযোগে আওয়ামী লীগকেই প্রথমে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান। এমনকি অভিযোগ আছে, অধিবেশন চলাকালীন আওয়ামী লীগ বাইরে থেকে দলীয় নেতাকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করিয়েছে। রাজনীতিবিদ কাজী জাফর আহমেদ ‘আমার রাজনীতির ৬০ বছর: জোয়ার-ভাটার কথন’ বইয়ে এই ঘটনায় উভয় পক্ষকে দায়ী করলেও আওয়ামী লীগকেই দায় বেশি দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের সুমহান উপাখ্যান। সে গৌরবগাঁথা ইতিহাসেও আওয়ামী লীগ যুক্ত করেছে এক লজ্জাজনক অধ্যায়, যা চাপা দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বসবাসরত হাজার হাজার অবাঙালি, বিহারি। নিহতের সংখ্যা নিয়ে কিছুটা বিতর্ক থাকলেও এই ঘটনার নির্মমতা অস্বীকার করা যায় না। এমনকি তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকার বাংলাদেশের ভূখণ্ডে তাদের চালানো কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’-কে এই হত্যাকাণ্ড দিয়ে জায়েজ করতে চেয়েছিল। ভারতীয় আমেরিকান সাংবাদিক শর্মিলা বোস এই হত্যাকাণ্ডকে ‘জেনোসাইড’ দাবি করেছেন। ‘ডেথ বাই গভর্নমেন্ট’ গ্রন্থে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিজ্ঞানী অধ্যাপক আর জে রুমেল এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে আওয়ামী লীগ দায়ী বলে দাবি করেছেন। মুক্তিযুদ্ধজুড়ে চলা এই গণহত্যা আমাদের মহান বিজয়ের ইতিহাসে কিছুটা হলেও কালিমালিপ্ত করে, যার দায় আওয়ামী লীগ কখনোই এড়াতে পারে না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশ গঠনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া আওয়ামী লীগের কুকীর্তির বর্ণনা সংবলিত কয়েকটি আস্ত উপন্যাস লিখে ফেলা যাবে।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণে ছেয়ে গিয়েছিল পুরো দেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের পরিবর্তে দেশকে অন্ধকারের অমানিশায় পৌঁছে দিতেই যেন বেশি বদ্ধপরিকর ছিল আওয়ামী লীগ নেতারা। এই অরাজকতার মধ্যে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নিয়ে গঠন করেন জাতীয় রক্ষীবাহিনী, লাল বাহিনী, মুজিব বাহিনী, গণবাহিনীর মতো বেশ কিছু প্যারামিলিটারি বাহিনী। এদের মধ্যে রক্ষীবাহিনী সব বর্বরতাকে হার মানিয়েছিল। গুম, খুনসহ নানা অরাজকতার পসরা সাজিয়ে পুরো দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল রক্ষীবাহিনী। এই আধা-সামরিক বাহিনীর বর্বরতা এতই ভয়াবহ ছিল যে একে ইতিহাসে কুখ্যাত হিটলারের গেস্টাপোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। বিরোধী দল ও মতের প্রতি চরম অসহিষ্ণুতা যেন আওয়ামী লীগের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। বিশেষ করে উপরিউক্ত বাহিনীগুলোর অন্যতম কাজই ছিল আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিববিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ‘ইধহমষধফবংয: অ খবমধপু ড়ভ ইষড়ড়ফ’ বইয়ে ১৯৭৩ সালের শেষে বাংলাদেশে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা ২ হাজারের অধিক বলে উল্লেখ করেন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাসনামলের শেষদিকে ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা ভারত থেকে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং শুরু হয় দলটির নবযাত্রা। কিন্তু নেতৃত্ব বদল হলেও দলটির ফ্যাসিস্ট চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি। সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বিএনপির ১৯৯১-৯৬ শাসনামলে আওয়ামী লীগ হরতালের নামে ১৭৩ দিন দেশজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। এ সময় দেশে সংঘাত, লুটতরাজের প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল খুব ব্যাপকভাবে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগ পর্যন্ত এই দুর্বৃত্তায়নে কনট্রিবিউটর হিসেবে সক্রিয় ছিল বিভিন্ন এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসীরা; যারা নিজ নিজ এলাকায় স্রেফ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে সন্ত্রাসের পথে হেঁটেছে, বিরোধীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছে। লজ্জার বিষয়, শেখ হাসিনা এই চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের বারবার সংসদের মতো পবিত্র জায়গায় দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছেন।
একইভাবে ২০০৪ সালে বিরোধী দলের দায়িত্বে থাকাকালীন রাজধানীর হোটেল রূপসী বাংলার (শেরাটন) সামনে বাসে আগুন দিয়ে নৃশংসভাবে ১১ জনকে পুড়িয়ে মারার পুরস্কারস্বরূপ পরবর্তী সময় আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানককে মন্ত্রিত্ব এবং মির্জা আজমকে সংসদের হুইপ করেছেন শেখ হাসিনা। বিশ্বের অন্য কোনো গণতান্ত্রিক, সভ্য দেশে এর নজির আর পাওয়া যাবে কিনা- সন্দেহ। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী বর্বরতা যেন আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এ দিন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে দলের নেতাকর্মীরা ধারালো অস্ত্র, লাঠিসোটা নিয়ে মাঠে নামে এবং জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৪ নেতাকর্মীকে পিটিয়ে হত্যা করে প্রকাশ্য দিবালোকে লাশের ওপর নৃত্য করার উš§ত্ততা দেখিয়েছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরও আওয়ামী লীগের দানবীয় চরিত্র বজায় থাকে। ২০১৩ সালে কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আওয়ামী মদদে দেশজুড়ে গণজাগরণ মঞ্চের ব্যানারে দেশবিরোধী অপশক্তি ইসলাম বিদ্বেষ এবং নৈরাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিল; তার প্রতিবাদে ‘হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’-এর ব্যানারে দেশের সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ সাধারণ জনতা মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নিলে সরকারের নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এবং আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বড় গণহত্যা চালিয়েছে। গণমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরে সব রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার তখন আওয়ামী লীগ মূলত এর ফ্যাসিবাদী চরিত্রের ভিত্তি মজবুত করেছে। ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার রক্তের বন্যা বইয়ে শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত তারা গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সহিংসতা ঘটিয়েই গেছে।
আওয়ামী লীগই একমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের দল, আওয়ামী লীগই স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি, আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের রক্ষকÑ এসব কল্পকাহিনি আওয়ামী লীগ বেশ ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। অথচ এ ধরনের আওয়ামী বয়ান জাতির সঙ্গে স্রেফ তামাশা ছাড়া কিছু নয়। নিজেদের স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি দাবি করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূল করা আওয়ামী লীগ লীগের হীন রাজনৈতিক এজেন্ডার একটি। স্কাইপ কেলেঙ্কারি, সাক্ষ্য-প্রমাণ জালিয়াতিসহ অসংখ্য অনিয়মে ভরা এসব বিচারিক প্রহসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের মতো উগ্র আওয়ামী বিচারপতিদের, যারা সরাসরি আওয়ামী লীগগের সুবিধাভোগী এবং নিজেদের ‘শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের নামে জাতিকে দ্বিভাজন আওয়ামী লীগের আরেক হীন প্রচেষ্টা। জামায়াত-শিবির বানিয়ে হত্যাকে বৈধ প্রমাণের অপচেষ্টা করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় মদদে। এর মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা বুয়েটের আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সারারাত ধরে পিটিয়ে হত্যা করা মেধাবী ছাত্রটিকেও হত্যার পর শিবির ট্যাগ দেয়ার অপতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে।
নিজেদের ‘স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী’ প্রোপাগান্ডা চালিয়ে আওয়ামী লীগ রমরমা চেতনা ব্যবসার আসর বসিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে গত ১৬ বছর ধরে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, মেগা প্রজেক্টের নামে মেগা দুর্নীতি, ঘুষের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ধসিয়ে দেয়া, ক্রীড়া, শিল্প খাত, কৃষি খাতসহ দেশের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিছুদিন অসংলগ্ন, ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে এবং কিছুদিন বুলেটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ দেশকে মেধাশূন্য করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে আওয়ামী লীগ দেশের কোনো শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী এর প্রতিবাদ জানাতে আসলে তাকে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী’ ট্যাগ দিয়ে অপদস্ত করা হয়েছে আওয়ামী লীগ দেশের অন্যতম গর্বের জায়গা বাংলাদেশ ক্রিকেটকে দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে যার প্রভাব পড়েছে দলের পারফরম্যান্সে। দেশের অর্থনীতিকে আওয়ামী লীগ এমন একটি অবস্থানে নিয়ে গেছে যাতে বাংলাদেশ আগামী ২০ বছরেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন সরকারের ঋণ ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা আওয়ামী লীগ আওয়ামী শাসনামলেই যা বেড়েছে ১৫ লাখ ৫৮ হাজার ২০৬ কোটি টাকা, যা সরকারের মোট ঋণের ৮৫ শতাংশ। অর্থাৎ বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া মোট ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার সরকারি ঋণ রেখে দেশ থেকে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা।
এছাড়াও বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ব্যাংকগুলো অবাধ লুণ্ঠনের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ ২০০৯ থেকে ২০২৩, এই ১৫ বছরে ২৪টি বড় ব্যাংক কেলেঙ্কারিতে প্রায় ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। এভাবে গত ১৬ বছরে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় খাতকেই ধ্বংস করা হয়েছে প্রত্যক্ষ আওয়ামী মদদে। নিজেদের স্বাধীনতার চেতনাপন্থি হিসেবে কল্পকাহিনি দাঁড় করিয়ে দেশকেই অস্তিত্বহীনতার দিকে নিয়ে যাওয়া বা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে একের পর এক দেশের স্বার্থ ভারতের কাছে জলাঞ্জলি দেয়া, ভারতকে খুশি রাখতে দেশের সার্বভৌমতার প্রতি হুমকিস্বরূপ একের পর এক দেশবিরোধী চুক্তি করাÑ কী করেনি আওয়ামী লীগ? আবার সংখ্যালঘুবান্ধব দল হিসেবে বয়ান তৈরি করে তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর চালিয়ে গেছে নির্যাতন। তাদের আওয়ামী লীগ স্রেফ দাবার ঘুঁটি হিসেবেই ব্যবহার করেছে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের চাপে ফেলতে। পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায়ের ওপর চালানো প্রায় প্রতিটি হামলা, নির্যাতনে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল।
এ ধরনের অনেক ঘটনায় এসব দুর্বৃত্তদের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ পেয়ে যাওয়ায় অধিকতর কোনো তদন্তও হয়নি। সারকথা তাদের প্রতিষ্ঠিত প্রতিটি কল্পকাহিনি তাদের কাজের সঙ্গে খুব বীভৎসরূপে স্ববিরোধী। আওয়ামী লীগের ইতিহাস ঘাঁটলে সহজেই বুঝা যায় তারা আসলে যা বলে তা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করে না আর তারা যা বিশ্বাস করে তা তারা বলে না। এ ধরনের অস্বচ্ছতা রেখে আর যা-ই হোক কল্যাণের রাজনীতি হয় না।
অভূতপূর্ব এক গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে শেখ হাসিনা নিজে বিচার থেকে আপাতত বাঁচলেও তার দল আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে খুনই করেছেন বলা যায়। পৃথিবীর কোনো দেশেই পতিত স্বৈরশাসক এবং তার দলের নিজ দেশে পুনর্বাসিত হওয়ার নজির নেই। কিন্তু ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রেক্ষাপটে বিচারের মুখোমুখি এবং জনরোষে পতিত হওয়ার ভয়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা গা-ঢাকা দিলেও এক শ্রেণির প্রোপাগান্ডিস্ট নানাবেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সরব। তারা নানা গুজব ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার প্রাণান্তকর চেষ্টা তো চালাচ্ছেই, পাশাপাশি গোয়েবলসীয় কায়দায় নতুন এক বয়ান তৈরি করতে চাইছে যে শেখ হাসিনা শুধু দেশের ও দেশের মানুষের কথা ভেবে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন এবং এর মাধ্যমে তিনি দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
তাদের এই প্রচার যে সর্বৈব মিথ্যা তা সাম্প্রতিক রাজনীতির খোঁজখবর রাখা প্রতিটা মানুষই জানেন। দেশীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে জানা যায় দেশ থেকে পালানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত শেখ হাসিনা সেনাপ্রধানকে ‘পুলিশ ভালো’ করতে পারলে সেনাবাহিনী কেন পারছে না এই মর্মে দুয়ো দিচ্ছিলেন। এটি স্পষ্ট যে তিনি যেকোনো মূল্যে, দেশকে রক্তের সাগরে ভাসিয়ে হলেও ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন, দেশের কথা তিনি কখনও চিন্তাও করেননি। দেশের প্রতি সামান্যতম দায়বদ্ধতাও যদি তার থাকত তাহলে হাজারও ছাত্রজনতাকে হত্যা করে তিনি ‘বিএনপি-জামায়াত-শিবির’ কার্ড খেলার নোংরা অপচেষ্টায় মেতে উঠতেন না; মেট্রোরেল, বিটিভির জন্য (বিবিসির ভাষায়) কুমিরের কান্না দেখাতেন না। অবশ্য নির্বাচনকে কৌতুকে পরিণত করে অবৈধভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা দলের প্রধান দেশ ও দশের কথা চিন্তা করবেন এমনটি আশা করাও যায় না।
আওয়ামী লীগ কিছু কল্পকাহিনি প্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে সুকৌশলে মানুষকে দ্বিধাবিভক্ত করে তার আড়ালে দেশকে অনিয়ম, খুন, দুর্নীতি, গুমরাজ্যে পরিণত করা ছাড়া আওয়ামী লীগ দেশকে তেমন কিছুই দিতে পারেনি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে ‘নির্দোষ’ দাবি করে আলোচনাকে একমাত্রিক করে ফেলা এখানে উদ্দেশ্য নয়। অবশ্যই রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যত ব্যর্থতা তাতে অন্য দলগুলোর দায়ও রয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার পার্থক্য হচ্ছে আদর্শগত বিচ্যুতি বনাম আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। আদর্শ থেকে বিচ্যুত হলে তা থেকে পরিত্রাণের উপায় থাকে কিন্তু আদর্শ পরিবর্তন ছাড়া আদর্শগত বিচ্যুতির কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই। আওয়ামী লীগের আদর্শগত বিচ্যুতির রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে। তাদের চরিত্রগত ফ্যাসিবাদ রুখতে দেশপ্রেমিক জনতার ঐক্যবদ্ধ কর্মতৎপরতার বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ গোয়েবলসীয় কায়দায় মিথ্যাকে যেন প্রতিষ্ঠিত করতে না পারে সেদিকে বাংলাদেশের সচেতন জনসাধারণ বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে তাদের কল্পকাহিনিগুলোকে অকার্যকর করে দিতে হবে আওয়ামী লীগ দেশে একশ্রেণির আওয়ামী বিবৃতিজীবী আছেন, যারা বিগত বছরগুলোয় আওয়ামী কল্পকাহিনিগুলো আওড়ে ফ্যাসিবাদের ভিত তৈরি এবং মজবুত করতে নিরলস কাজ করেছেন।
তাদের চিহ্নিত করাটা খুবই প্রয়োজন। এদের মধ্যে একটা অংশ এখন খোলস পাল্টে বিপ্লবী সেজে গেলেও দেশে পান থেকে চুন খসলেই বর্তমান বিপ্লবী বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের মিল খুঁজতে বসেন। এরা মূলত ফ্যাসিবাদের দোসর। এদের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে এবং কাউন্টার কল্পকাহিনি তৈরির মাধ্যমে এদের মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। অন্যথায় ফ্যাসিবাদ মাথার ওপর আবার জেঁকে বসবে- অন্য ধাঁচে, অন্য কৌশলে।