Print Date & Time : 20 June 2025 Friday 2:22 pm

কল্যাণমুখী ব্যাংকিংয়ের ২৭ বছর

জাফর আলম: কল্যাণমুখী ব্যাংকিং ধারার প্রবর্তন এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ব্যাংকিং সেবা দেশের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালের ২২ নভেম্বর সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) দেশের দ্বিতীয় প্রজšে§র একটি ব্যাংক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদাপনের এই শুভক্ষণে সম্মানিত গ্রাহক, শেয়ারহোল্ডার ও শুভানুধ্যায়ীদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই গ্রাহকরা সর্বাধুনিক সেবা পায় সে দিকে সবসময় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। নতুনত্ব ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে দেশব্যাপী বিস্তৃত ১৭৯টি শাখা, ১৪৫টি উপশাখা, ৩০৮টি এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট এবং ১৯৬টি এটিএম বুথের মাধ্যমে দেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিচ্ছে। গত বছরের ডিসেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশের প্রান্তিক জনগণের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে আমরা দেশব্যাপী ৭টি জোনাল অফিস স্থাপন করেছি।

ইতোমধ্যে ব্যাংকিং সেবাপণ্য বহুমুখীকরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। উৎকর্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে সমাজের সব মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনয়নের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দায়িত্ব নেয়ার পরই ব্যাংকের সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি আমানত ও বিনিয়োগসহ বেশ কিছু নতুন সেবাপণ্য যুক্ত করা হয়েছে। ফলে গত বছরের চেয়ে এ বছর ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যাংকের নন-ফান্ডেড ব্যবসা যেমন আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে ব্যাংকের পরিচালন মুনাফাও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকের আমানত ৮.১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৬,১৪২ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি বিনিয়োগ ১০.৫৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৪,১৩৯ কোটি টাকা। অন্যদিকে শ্রেণিকৃত বিনিয়োগের পরিমাণও ৫.৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে বর্তমানে ৪.৮৯ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। আমানত গ্রাহক বেড়েছে ১০.৬৬ শতাংশ। পাশাপাশি ২১.১৫ শতাংশ জনবল বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়া উপ-শাখা, এজেন্ট আউটলেট, এটিএম বুথ, ডেবিট কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডের সম্প্রসারণের মাধ্যমে ব্যাংকের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

গত ছয় মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশ সফলতা এসেছে। এ সময়ে সার্বিক বৈদেশিক বাণিজ্য বেড়েছে ৪২.৬১ শতাংশ। এর মধ্যে রপ্তানি ৩৫.১৯ শতাংশ, আমদানি ৪২.৮৩ শতাংশ এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ ৭১.২১ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ফরেন করেসপন্ডেন্ট প্রায় ৫ শতাংশ বেড়েছে।

দেশের সব শ্রেণির মানুষকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে রয়েছে একটি বিস্তৃত সেবা ভান্ডার। ২০২১ সাল পর্যন্ত এ ব্যাংকের ডিপোজিট প্রোডাক্ট ছিল ২১টি। মানুষের মৌলিক বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২২ সালের শুরুতেই চালু করা হয়েছে এসআইবিএল শিক্ষা সঞ্চয় স্কিম, এসআইবিএল চিকিৎসা সঞ্চয় স্কিম এবং এসআইবিএল বিবাহ সঞ্চয় স্কিম নামে আরও তিনটি নতুন ডিপোজিট প্রডাক্ট। এই প্রোডাক্টগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো এগুলো শুধু সঞ্চয় প্রকল্পই নয়, প্রয়োজনে এসব স্কিমের বিপরীতে সঞ্চয়ের দ্বিগুণ বিনিয়োগ গ্রহণের সুবিধা রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই স্কিমগুলো সর্বস্তরের মানুষের মাঝে সাড়া ফেলেছে। এছাড়া খুব শিগগিরই প্রবাসী ডিপোজিট স্কিম, রিটায়ার্ড সিটিজেন মান্থলি বেনিফিট স্কিম, হকার্স ডিপোজিট অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন স্কিম এবং মুদারাবা ঐচ্ছিক ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট নামে চারটি নতুন ডিপোজিট প্রোডাক্ট চালু করা হবে।

এর পাশাপাশি রয়েছে ২৫ ধরনের বিনিয়োগ সেবা, ১১ ধরনের এসএমই বিনিয়োগ, ৩ প্রকার কৃষি বিনিয়োগ এবং ৬ ধরনের ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড এবং আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্সসহ সব বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত সেবা। কনজ্যুমার বিনিয়োগের আওতায় শিক্ষার্থীদের অতি প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস যেমনÑকম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি শিক্ষা উপকরণ ক্রয়ের জন্য বিনা জামানতে বিনিয়োগ সুবিধা চালু হয়েছে এ বছরই। সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংক বা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী, প্রফেশনালস (যেমন: ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিএ/এফসিএ), বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দেশে ব্যবহƒত সেকেন্ড হ্যান্ড গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ গ্রহণের সুবিধা চালু করেছি। এছাড়া সম্প্রতি বাড়ির ছাদে শখের বাগান করতে এসএমই ও কৃষি বিনিয়োগের আওতায় বিনা জামানতে ছাদ কৃষি বিনিয়োগ চালু করা হয়েছে।

২৪ ঘণ্টা গ্রাহক সেবার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ কল সেন্টার চালু করেছি। চালু করা হয়েছে এসআইবিএল মোবাইল অ্যাপ ‘এসআইবিএল নাউ’। এই অ্যাপ ব্যবহার করে গ্রাহকরা মোবাইল রিচার্জ থেকে শুরু করে ব্যাংক হিসাব খোলা, ডিপোজিট ও ইনভেস্টমেন্ট হিসাবের কিস্তি জমা, ফান্ড ট্রান্সফার, ইউটিলিটি বিল প্রদান, ক্রেডিট কার্ডের বিল প্রদান, কিউআর কোড দিয়ে টাকা উত্তোলন, বিকাশ ও নগদে ফান্ড ট্রান্সফার, ব্যালান্স অনুসন্ধান,  ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের ব্যবহার, কল সেন্টারের মাধ্রমে ওটিপি ভেরিফিকেশন, ব্যাংকের শাখা, উপশাখা ও এটিএম বুথের অবস্থান ইত্যাদি সেবা পাচ্ছেন। ঘরে বসেই গ্রাহক এখন ই-অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে মোবাইলে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন এবং কিউআর কোড দিয়ে চেকবই বা ডেবিট কার্ড ছাড়াই গ্রাহকরা শাখা থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছেন।

‘এসআইবিএল নাউ’ অ্যাপ ব্যবহার করে বিদেশে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীরা (এনআরবি) মোবাইল থেকেই ই-অ্যাকাউন্ট খুলতে খুলতে পারছেন। এই হিসাব খুলে এনআরবি অ্যাকাউন্ট হোল্ডার একটি ডুয়াল কারেন্সি ডেবিট কার্ড পাচ্ছেন যেটি দিয়ে দেশে-বিদেশে সব জায়গায় কেনাকাটা, টাকা উত্তোলন ও অনলাইন ট্রানজেকশন করা যায়। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের এ সেবার ফলে দেশে বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পাবে।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক প্রথম বাংলাদেশি ব্যাংক হিসেবে মানি গ্রামের সঙ্গে এপিআই-এ যুক্ত হয়েছে যার মাধ্যমে দ্রুত রেমিট্যান্স সেবা প্রদান সম্ভব হচ্ছে এবং গ্রাহকদের পাঠানো রেমিট্যান্স সরাসরি তাদের অ্যাকাউন্ট ও ওয়ালেটে জমা  হয়। প্রথম ব্যাংক হিসেবে আমরা সুইফট গো সিস্টেম বাস্তবায়ন করেছি এবং এই সিস্টেম গ্রহণ করার জন্য সুইফট থেকে ১ লাখ ইউরো প্রণোদনা পেয়েছি। এছাড়া প্রথম বাংলাদেশী ব্যাংক হিসেবে তহবিল সংগ্রহের জন্য ৭৫ মিলিয়ন আন্তর্জাতিক সুকুক ইস্যু করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পেয়েছে।

এসআইবিএল ইনস্ট্রা ফ্যামিলি রেমিট, ইনস্ট্রা এডু এবং ইনস্ট্রা মেডি রেমিট নামে তিনটি আউটবাউন্ড রেমিট্যান্স সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশি নাগরিকের বিদেশে অধ্যয়নের জন্য অথবা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দ্রুত সময়ে বিদেশে পাঠাতে পারবেন এবং বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশি নাগরিকরা উপার্জিত অর্থ নিজ দেশে পাঠাতে পারবেন। ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নের মাধ্যমে মিনিটেই রেমিট্যান্স পাঠানোর এ সেবা উদ্ভাবনের জন্য সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ‘বেস্ট ইনোভেশন- ফাইন্যান্স ইনোভেশন ইন ব্যাংকস’ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড-২০২২ পুরস্কার লাভ করে।

ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পরিচালিত আওকাফ প্রপার্টিজ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের মালিকানায় যুক্ত হয়েছে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক। এই ফান্ডে বিনিয়োগের জেরে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অন্যান্য বিনিয়োগ সহযোগীর সঙ্গে এ ব্যাংকের সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে ব্যাংকের মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি আমাদের ব্যাংক স্পেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানে ৩টি নতুন এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এবং ওমান, সংযুক্ত আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে আরও ৫টি এক্সচেঞ্জ হাউসের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে যাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রবাহে আরও বেশি অবদান রাখবে।

অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ব্যাংকটিকে সম্পূর্ণ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে পরিণত করার নিমিত্তে সর্বস্তরে শরিয়াহ পরিপালনে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালিত হয়। ব্যাংকটির উন্নয়ন টেকসই করার জন্য নিয়মিতভাবে সর্বস্তরের কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে প্রশিক্ষণ কর্মশালা পরিচালিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক আয়োজিত ‘সাসটেইনেবিলিটি রেটিং রিকগনিশন সেরিমনি’ অনুষ্ঠানে টেকসই ব্যাংক হিসেবে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক সনদ লাভ করেছে।

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড