‘কষ্টরা খালি পায়ে হাঁটে’ কবি নূরুল ইসলামের একক কবিতার বই। বইটি এনেছে অন্যধারা পাবলিকেশনস। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন প্রয়াত কবি মাহবুবুল হক শাকিলকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে পড়ালেখা শেষে সাংবাদিকতা করেছেন নূরুল ইসলাম। ভ্রমণপিয়াসী মানুষটি দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। প্রসারিত দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন সমাজ, সংসার আর প্রেমের সাতকাহন।
‘কষ্টরা খালি পায়ে হাঁটে’ বইটিতে কবিতার সংখ্যা ৮২। প্রথম কবিতা ‘অতঃপর অমানিশা’র মধ্য দিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে প্রকৃতির আরাধ্য দেবতা প্রেম। অতীতের গহন স্মৃতি কবিকে তাড়িত করে। অতীতে হারিয়ে যাওয়া কাক্সিক্ষত প্রেম স্মৃতি হয়ে ফিরে আসে প্রকৃতির কাঠবাদামের ঝোপে, হলুদ টিয়া ও জ্যোৎস্নার ছদ্মবেশে। কবিতার চিত্রকল্প পাঠককে নিয়ে যায় কবির অন্তমহলে। প্রেম উদারতা শেখায়। গমনোদ্যত প্রিয়তমাকেও কবির শুভেচ্ছাÑ
‘ইচ্ছেগুলো নিজের মতো গুছিয়ে নিও
ভালো থেকো’
জীবন মানেই পাওয়া না পাওয়ার দোলাচল, দ্বন্দ্ব। ‘তবুও হাল ছাড়েনি হƒদয়’ কবিতাটির ছন্দের মধ্য দিয়ে কবি জীবনের চালচিত্র তুলে ধরেছেন। যে প্রেম কবিকে দিয়েছে দোলা, তার বর্ণনা পাঠককে নিয়ে যাবে ফেলে আসা জীবনে। এখানেই কবির সার্থকতা।
‘নারী’ কবিতার মধ্য দিয়ে অভিমানী যুবক নারীকে দাঁড় করিয়েছে কাঠগড়ায়। ‘নিরুপায়’, ‘বেওয়ারিশ’ কবিতায় কবি এক উš§াতাল প্রেমিকÑযে নারীকে চেনে, যে ভালোবাসা পেতে চায়। কিন্তু অসম্ভব আত্মসমালোচক কবি বলে দেনÑ
‘আমাকে ছুঁইও না নারী
আমি ভালোবাসাহীন গরল’
মৃত্যুবিষয়ক ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে তিনটি কবিতায়। ‘কফিনের ভেতরে আমি’ কবিতায় কবি মৃত্যুর স্তব্ধতার ভেতরেও খোঁজেন তার প্রিয়তমাকে। এ যেন এক পলায়নপর লিবিডো চেতনার অধিকারী বিনাশী সত্তা। মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে সমাজের যে চিরন্তন রূপরেখা, তা কবির কাছে আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
কবির ক্ষয় নেই। ‘কবির মৃত্যু’ কবিতায় কবি নূরুল ইসলাম কোনো এক কবির মৃত্যুতে আলোড়িত হয়ে সেই সত্যকে অঙ্কন করেছেনÑ
‘কবিরা ত্রিকালজ্ঞ একেকটা কবি দগদগে মহাকাল
কবিরা মৃত্যুহীন’
সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত রাশেদ স্মরণে প্রতিবাদমুখর হয়েছেন কবি। লিখেছেন ‘একটি প্রতিভাবান স্বপ্নের মৃত্যু’ কবিতা।
অনুভূতির গভীরতা লক্ষ করা যায় ‘পয়মন্ত সময়’ কবিতায়। ‘অনু কবিতার’ মাধ্যমে কবি তার মনের জানালায় প্রেমের আলো জ্বালিয়েছেন। ‘কথোপকথন’ কবিতাটি লুক্কায়িত প্রেমকে মূর্ত করে তুলেছে, যা পাঠককে মুগ্ধ করবে।
কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কবি কিছুটা নিরীক্ষাধর্মী। যতিচিহ্ন ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভিন্নতা লক্ষণীয়। বাক্যের পর বাক্য আপনা থেকেই থেমে যায়। নেই কোনো কমা, দাঁড়ি; কিন্তু অর্থ তার স্বাভাবিকভাবেই প্রকাশিত। ছন্দের সাজে এনেছেন বৈচিত্র্য। গৎবাঁধা কাব্যের মাত্রাকে তার ইচ্ছের ধারায় বইয়ে দিয়েছেন। ছন্দের ক্ষেত্রে একাধারে মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সাজিয়েছেন তার কবিতা। অলংকারের আতিশয্য না থাকলেও বাস্তব জীবনের সঙ্গে কবির রোমান্টিক মনের বিরোধ ঘটেছে প্রায়ই। উপমা ব্যবহারে কবি সাবলীলতার পরিচয় দিয়েছেন। জীবন, জীবনের ক্ষত আর প্রেম যেন একই সরলরেখায় হয়েছে সমান্তরাল। ছোট ছোট বেশকিছু কবিতার মধ্য দিয়ে কবির গভীর মনের ছোঁয়া পাওয়া যায়। চেতনার আলোড়িত ধ্বনি উঠে এসেছে কবিতার শরীর ছুঁয়ে। কবি তখনই সার্থক, যখন তার অনুভূতিকে মুক্তি দিতে পারেন পাঠকের মনের আয়নায়। আর কবি নূরুল ইসলাম তার কাব্যগন্থ ‘কষ্টরা খালি পায়ে হাঁটে’র মাধ্যমে সফলতা অর্জন করেছেন বলে আমি মনে করি।
শারমিন তামান্না
সহকারী অধ্যাপক (বাংলা)
ঢাকা উদ্যান সরকারি মহাবিদ্যালয়
মোহাম্মদপুর, ঢাকা
Add Comment