মো. সিরাজুল হক: সাম্প্রতিক সময়ে মৎস্য খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি কৃষির অন্যান্য উপখাতের তুলনায় অনেক বেশি। এ দেশের খাদ্য নিরাপত্তা বিধানেও মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রায় ৬০ শতাংশ প্রাণিজ আমিষের জোগান দেয় মাছ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১২ শতাংশ অর্থাৎ ২ কোটির বেশি মানুষ এ সেক্টরের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত থেকে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বিগত পাঁচ বছরে এ খাতে অতিরিক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক বেড়েছে।
বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। মৎস্য খাত কৃষি খাতের একটি প্রধান উপখাত হিসেবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। পুরুষের পাশাপাশি দেশের ১৪ লাখের বেশি নারী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্য খাতের বিভিন্ন কার্যক্রমে নিয়োজিত রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের কাছে চিংড়ির পোনা সংগ্রহ এবং শুঁটকি প্রক্রিয়াকরণ করে বিক্রি করা অর্থ উপার্জনের একটি অন্যতম প্রধান মাধ্যম। উপকূলীয় এলাকায় মৎস্য খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমশক্তির ৮০ শতাংশই নারী। মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ মৎস্য উপখাতের অবদান। কৃষিজ জিডিপিতে এর অবদান ২৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
উপকূলীয় জেলাগুলো ছাড়াও দেশের প্রায় ১০টি জেলার কয়েক লাখ নারী প্রশিক্ষণ নিয়ে গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি মাছের শুঁটকি তৈরি, সংরক্ষণ এবং বিক্রি করে বাড়তি আয় করছে। নারীরা মাছ চাষেও ব্যাপকভাবে এগিয়ে এসেছে। বাড়ির নিকটবর্তী ছোট পুকুর বা ডোবা, ধানক্ষেত এবং বড় পুকুরে খাঁচায় মাছ চাষ করছে নারীরা। উপকূলীয় জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। কাঁকড়া চাষের সঙ্গে জড়িতদের বেশিরভাগই নারী। বাংলাদেশ থেকে এখন চীন এবং জাপানে কাঁকড়া রপ্তানি হচ্ছে। মাছ আহরণের উপকরণ তৈরিতে নারীরা অবদান রাখছেন। মৎস্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ জরিপ মতে, মৎস্য খাতে মোট শ্রমশক্তির ৩৬ শতাংশ নারী। মৎস্য খাতকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
মাছের বাজার মূল্য এবং পুষ্টিকর খাদ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মৎস্য চাষ একটি লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে অসংখ্য আধুনিক এবং বাণিজ্যিকভাবেও মৎস্য খামার গড়ে ওঠছে। বর্তমানে কৃষি ফসলের সঙ্গে মৎস্য চাষের একটি প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। সারাদেশের ভরাট হয়ে যাওয়া অসংখ্য সরকারি খাস জলাশয়ে পুকুর, দিঘি, নদী, বিল, হাওর প্রভৃতি সংস্কারের মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতিতে মৎস্য চাষ করে উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন অব্যবহƒত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে।
প্রবাদ আছে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। আর ভাতের সঙ্গে এখনও আমাদের প্রধান সম্পূরক খাবার মাছ। নদীমাতৃক বাংলাদেশের অসংখ্য নদী, হাওর-বাঁওড়, খাল-বিল মৎস্য সম্পদে ভরপুর। কৃষি জিডিপি’র ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ আসে মৎস্য খাত থেকে। দেশের মৎস্য খাত অভ্যন্তরীণ ও সামুদ্রিক দুটি ভাগে বিভক্ত। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে উš§ুক্ত স্থানে মৎস্য আহরণের অবদান ২৮ শতাংশ, চাষের মৎস্যের অবদান ৫৭ শতাংশ এবং সামুদ্রিক মৎস্যের অবদান প্রায় ১৬ শতাংশ। বিশ্ব খাদ্য এবং কৃষি সংস্থার ২০২০ সালের হিসাব মতে, বাংলাদেশ মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় এবং অভ্যন্তরীণ মৎস্য চাষে বিশ্বে পঞ্চম।
সামুদ্রিক মৎস্যকে শিশুপুষ্টির অন্যতম প্রধান উৎস ধরা হয়। সামুদ্রিক মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড এবং ভিটামিন-ডি থাকে, যা শিশুদের স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। স্যামন, টুনা, সার্ডন, পোয়া, রূপচাঁদা, কোরাল ইত্যাদি মাছে প্রচুর পরিমাণ ওমেগা- ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। এছাড়া সামুদ্রিক মাছে প্রচুর আয়োডিন থাকে। আয়োডিনের অভাবে শিশুদের গলগণ্ড রোগ, মানসিক প্রতিবন্ধিতাসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। আয়োডিন মানুষের শরীরে খুব সামান্যই প্রয়োজন হয়। এ সামান্য অয়োডিন মানুষের শরীরে অনেক বড় প্রভাব ফেলে। আয়োডিনের অভাবে গর্ভবতী মায়েরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়। তাই সামুদ্রিক মাছ নারী ও শিশুদের অনেক রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে।
বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১, টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) ও ডেল্টা প্ল্যান ২১০০-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে মৎস্য খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাব মোকাবিলা এবং বাংলাদেশে পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহ ও গ্রাম পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা হলো ‘দেশের আনাকে-কানাচে প্রতি খণ্ড জমি পতিত না রেখে উৎপাদনশীল কাজে ব্যবহার করতে হবে’। অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের অংশ হিসেবে মৎস্য অধিদপ্তরাধীন উন্নয়ন কার্যক্রমের পাশাপাশি জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এটি অক্টোবর ২০১৫ থেকে জুন ২০২২ মেয়াদে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এ প্রকল্পের আওতায় সারাদেশের ৬১টি জেলার ৪৯টি উপজেলার মোট ২ হাজার ৫৯৭ দশমিক ৪৩ হেক্টর তালিকাভুক্ত পতিত/অব্যবহƒত বিভিন্ন জলাশয় পুনঃখননের মাধ্যমে মৎস্য চাষ উপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে ১০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি অতিরিক্ত মাছ উৎপাদনসহ প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
গত অর্থবছরে খননকৃত জলাশয়ে ১০ হাজার ৬০০ জন সুফলভোগীকে সংগঠিত করে আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব মাছ চাষের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যেও দেশব্যাপী চলমান এ প্রকল্প মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
সুস্থ-সবল ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে মৎস্য খাতের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাতীয় অর্থনীতিতে এ সম্ভাবনাময় সেক্টরের ভূমিকা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি মৎস্য সম্পদ উন্নয়নের ওপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। এ প্রেক্ষাপটে গত ২৮ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১ পালিত হয়। এ বছর জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২১-এর প্রতিপাদ্য বিষয় ‘বেশি বেশি মাছ চাষ করি, বেকারত্ব দূর করি’।
প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দেশে মাছ চাষে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সুপারিশ মতে, আমিষের অভাব পূরণের লক্ষ্যে জনপ্রতি বার্ষিক কম করে হলেও ১৮ কেজি মাছ খাওয়া উচিত। মাছে-ভাতে বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও এ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমাদের বার্ষিক মাছ খাওয়ার হার ছিল মাত্র ১৩ থেকে ১৪ কেজি। অথচ ২০২০ সালে আমাদের জনপ্রতি বার্ষিক হার হয়ে গেছে ২৩ কেজি, যেখানে পৃথিবীতে ২০২০ সালে মাথাপিছু গড় হার ছিল ২০ কেজি ৫০০ গ্রাম। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মৎস্য খাতে উন্নয়নের বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমরা জানি, বর্তমানে পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত। আর দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। মৎস্য খাতও বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হতে পারে। গবেষণাভিত্তিক বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও প্রবন্ধে মৎস্য বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশকে মৎস্য চাষের জন্য পৃথিবীতে সবচেয়ে উপযোগী স্থানগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানকার জলবায়ু, তাপমাত্রা, পানি, মাটি, জীববৈচিত্র্য সবই মৎস্য চাষের জন্য খুবই অনুকূল। সেই সঙ্গে দেশব্যাপী খাল, বিল, নদী, নালা, ডোবাসহ বিপুলসংখ্যক পুকুরের অবকাঠামো তো রয়েছেই। পরিকল্পনাভিত্তিক একটু সহযোগিতা পেলেই প্রত্যেকটা পুকুর হতে পারে অধিক ঘনত্বে মৎস্য উৎপাদনের একেকটি কারখানা, যেখানে অধিকাংশ নারী শ্রমিককে কাজে লাগানো যেতে পারে। সোনার বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু আজ থেকে প্রায় অর্ধশত বছর আগেই এ উপলব্ধি করেছিল। বঙ্গবন্ধু মাছে ভাতে বাঙালির সঙ্গে মাছের যে সম্পর্ক তার অন্তর্নিহিত শক্তিকেও অনুধাবন করেছিলেন। তারই দেখানো পথ অনুসরণ করছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাছ উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ, প্রশিক্ষণ, প্রদর্শনী এবং সরকারের প্রণোদনা বাংলাদেশে মৎস্য খাতে সফলতার মূল কারণ। এছাড়া হাওর ও বিলে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ, মা ইলিশ সুরক্ষা, মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করাতে বড় সাফল্য এসেছে। প্রজনন মৌসুমে ৬৫ দিন মৎস্য শিকার বন্ধ রাখা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার মাধ্যমে মা মাছ রক্ষা করা হচ্ছে। মা ইলিশ সুরক্ষায় সরকারের সফলতার ফলেই প্রচুর বড় ইলিশ বাজারে দেখা যাচ্ছে। খাদ্য এবং কৃষিসংস্থার তথ্য অনুযায়ী ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে প্রথম, যার পরিমাণ ৫ দশমিক ১৭ লাখ মেট্রিক টন। ইলিশ মাছের উৎপাদন বাড়াতে নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে মাছ ডিম দিচ্ছে, বর্ষায় তা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় মাছ ইলিশসহ বিলুপ্ত প্রায় মছের ওপর গবেষণা করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে দেশ। দেশ মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে মাছ কিনতে পারছে, পুষ্টিও পাচ্ছে।
গত ১০ বছরে মৎস্য খাতে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। এ ইনস্টিটিউট থেকে ইতোমধ্যে মৎস্য চাষ ও ব্যবস্থাপনাবিষয়ক ৬২টি টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তিসমূহ মৎস্য অধিদপ্তর এবং বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণের ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মৎস্য উৎপাদন ৪৫ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে।
সরকারের মৎস্য খাতে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, মৎস্যচাষি ও মৎস্যজীবী জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন, আপামর জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণ, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং কাক্সিক্ষত আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এ কার্যক্রমকে আরও বেগবান করতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলেই এক সময়ের ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটি শুধু কমাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, এটি রূপায়িত হবে বাস্তবেও বটে।
পিআইডি নিবন্ধন