প্রতিনিধি, নীলফামারী: সরিষার বাম্পার ফলন আশা করছেন নীলফামারীর কৃষকরা। জমি ফেলে না রেখে অল্প সময়ে এক জমিতে তিন ফসল চাষাবাদ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন নীলফামারী সদরের কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের কাছাড়ীপাড়া গ্রামের ১৪০ জন কৃষক। সরিষা থেকে অর্জিত অর্থ দিয়ে বোরো ধান চাষ করতে পেরে কৃষকরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নীলফামারী সদর, ডোমার, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলায় ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৬ হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়েছে।
সূত্র জানায়, গত বছর সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫ হাজার ৫৫৫ হেক্টর। তখন ৫ হাজার ৫৮০ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষাবাদ হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এক হাজার ১৯৭ হেক্টর বেশি জমিতে এ ফসলের চাষাবাদ হয়। সূত্র আরও জানায়, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের সরিষা চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করে আসছে কৃষি বিভাগ। এখন এর সুফল পেতে শুরু করেছেন কৃষকরা।
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে জেলায় সরিষা উৎপাদন হবে নয় হাজার ১০০ মেট্রিক টন। এ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ে পাঁচ হাজার ৩৭০ হেক্টর জমির সরিষা কর্তন করা হয়েছে। উৎপাদন হয়েছে (চলমান) সাত হাজার ৫৭০ মেট্রিক টন। পুরো কর্তন শেষ হলে জেলায় ভোজ্যতেলের চাহিদা মিটাবে ২০ শতাংশ।
উফশী জাতের সরিষা চাষাবাদ করে কৃষকরা অধিক মুনাফা লাভ করবেন বলে দাবি করেন উপজেলা ও জেলা কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষক সরিষার আবাদ করে বাম্পার ফলনের আশা করছেন। ৭০ থেকে ৮০ দিনের আবাদে কৃষকদের খরচও তুলনামূলক কম হবে। আমন ধান ওঠার পর একই জমিতে হালচাষ করে সরিষা আবাদ করে ঘরে তুলেন কৃষক। পরে সেখানে বোরোর বাম্পার ফলন হয়।
কুন্দুপুকুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. রশিদুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রামটি এখন সরিষা গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। এক গ্রামে ১৪০ জন কৃষক সরিষা চাষি ৩০০ বিঘা জমিতে (৯২ দশমিক ৩০৭ একর) সরিষার চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরিষার ফুল ঝরে পড়ে জৈব সার তৈরি হয়। এতে বোরো চাষে সেচ ও খরচের পরিমাণ খুবই কম লাগে। মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পায় ও পানি ধরে রাখে। এছাড়া গো-খাদ্য, পারটেক্স তৈরি, খৈল ও মাছের খাদ্য হিসেবে বাজারে এর চাহিদাও বেশি।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকারের কৃষি প্রণোদনায় সার এবং বিনা খরচে উন্নত জাতের বীজ সরবরাহের কারণে উফশী জাতের সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন গ্রামগঞ্জের কৃষকরা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলনের আশা করছেন কৃষক।’
তিনি বলেন, ‘এ বছর উপজেলায় দুই হাজার ৯৮৫ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে দুই হাজার হেক্টর জমির সরিষা কর্তন করা হয়েছে। কর্তনকৃত সরিষার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৩২৮ মেট্রিক টন। মোট জমিতে এক হাজার ৭৩১ মেট্রিক টন সরিষা উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এদিকে প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ৫ থেকে ৬ মন।’
কাছাড়ীপাড়ার সরিষা চাষি আব্দুর রশিদ বলেন, ‘এক বিঘায় সরিষার ফলন হয় ৫ থেকে ৬ মন। গত বছর প্রতি মণ সরিষা ১ হাজার ৮০০ থেকে ১ হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। সয়াবিন তেলের দাম বেশি থাকার ফলে এ বছর নতুন সরিষার বাজারে কৃষকরা ৩ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন। সরিষার চাষ পদ্ধতি খুবই সহজ ও কম খরচে অল্প সময়ে আশানুরূপ ফলনে কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে।’
একই গ্রামের কৃষক আবু কালাম বলেন, ‘গত বছর দুই বিঘা জমিতে সরিষার চাষ করে দাম ও ফলন ভালো পাওয়া এ বছর ১৪ বিঘা জমিতে সরিষার আবাদ করেছি। ইতোমধ্যে রোপিত জমি থেকে সরিষা উঠাতে শুরু করেছি।’ নিজের চাহিদা মেটানোর পর বিক্রি করে লাভবান হবেন আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমন ও বোরোর মধ্যবর্তী সময় ‘ফাও ফসল’ পাওয়া যাচ্ছে। দফায় দফায় সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস। উৎপাদিত তেল নিজে খাব ও বিক্রি করে লাভবান হবো।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. এস এম আবু বকর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘জেলার ছয় উপজেলায় ছয় হাজার ৭৭৭ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়েছে। এতে উৎপাদিত সরিষার পরিমাণ দাঁড়ায় নয় হাজার ১০০ মেট্রিক টনে এবং এর থেকে ভোজ্যতেল পাওয়া যাবে ৩৬ লাখ ৪০ হাজার লিটার, যা দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করবে। অপরদিকে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার শতকরা ৯০ শতাংশ টাকা বিদেশে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী স্থানীয়ভাবে সরিষা উৎপাদনে গুরুত্ব আরোপ করায় জেলায় এবার সরিষা চাষে আশার আলোর দেখছেন কৃষকরা।’
তিনি আরও বলেন, “এ জেলার মাটি সরিষা চাষের জন্য খুবই উপযোগী। সরিষা চাষিদের যথাযথ পরামর্শ ও সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ। প্রতি বছরই বাড়ছে সরিষার আবাদ। সদরের কাছাড়ীপাড়া গ্রামে ১৪০ জন কৃষক ৩০০ বিঘা জমিতে সরিষা চাষ করে গ্রামটি এখন ‘সরিষা গ্রাম’ নামে পরিচিতি পেয়েছে।’’