ইসমাইল আলী: গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সাড়ে ২০ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশা চূড়ান্ত করা হয়। আর ঠিকাদার নিয়োগ করা হয় গত বছর। তবে এখনও পুরোদমে শুরু হয়নি বিআরটির নির্মাণকাজ। এই মধ্যে বাড়ছে প্রকল্পটির ব্যয়। এরই মধ্যে ১১৮ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকল্পটির ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পটিতে বাড়তি অর্থায়ন বরাদ্দ দিতে সম্মত হয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। আর গত সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত বিআরটি প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। শিগগিরই বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধন প্রস্তাব যাবে পরিকল্পনা কমিশনে।
সওজের তথ্যমতে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বিআরটির ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৯ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। নতুন প্রস্তাবে এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৪৪১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রকল্পটির ব্যয় বাড়ছে দুই হাজার ৪০২ কোটি তিন লাখ টাকা বা ১১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের একাংশের পরিচালক একিউএম ইকরাম উল্লাহ শেয়ার বিজকে বলেন, প্রকল্পটির বিস্তারিত নকশার ভিত্তিতে ব্যয় পুনর্মূল্যায়ন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রস্তাবিত সাতটি ফ্লাইওভার দুই লেনের পরিবর্তে চার লেন করা হচ্ছে। ফলে এ খাতে ব্যয় বাড়ছে। এছাড়া মূল পরিকল্পনায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো) বাস কেনার কথা থাকলেও এখন তা বাড়িয়ে ১১০টি করা হয়েছে। আর জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদেরপুনর্বাসন, পরিষেবা সংযোগ সেবা স্থানান্তর ও বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় বেড়েছে।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন বিলম্বের যুক্তিতে দর সমন্বয় ও অনিশ্চিত খাতেও ব্যয় বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। প্রথমে খাত দুটিতে ব্যয় ধরা হয়েছিল যথাক্রমে ৪৭ কোটি ৬৪ লাখ ও ২৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ২৭৫ কোটি ৯২ লাখ ও ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ দর সমন্বয় খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ২২৮ কোটি ২৮ লাখ ও অনিশ্চিত খাতে ৪৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। আর নির্মাণ খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়েছে এক হাজার ২৩২ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এর বাইরে প্রকল্পটির জন্য জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন খাতে ব্যয় বেড়েছে ২৯৯ কোটি ৫২ লাখ, পরিষেবা সংযোগ লাইন স্থানান্তরে ২০ কোটি ২২ লাখ, বাস কেনায় ৪০৯ কোটি ২৫ লাখ, সরবরাহ ও সেবা খাতে ১৫৭ কোটি ৬৭ লাখ টাকা ব্যয় বেড়েছে।
প্রসঙ্গত, বিআরটি নির্মাণে এক হাজার ২৮০ কোটি সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এডিবি। এছাড়া ৩৬০ কোটি টাকা দেবে এজেন্সি ফ্রান্স ডি ডেভেলপমেন্ট (এএফডি) ও ৩৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ)। আর ৩৬৩ কোটি চার লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করার কথা ছিল। নতুন হিসাবে আরও এক হাজার ২১৬ কোটি টাকা দেবে এডিবি। এতে এডিবির ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে দুই হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। বর্ধিত ব্যয়ের বাকি অর্থ সরকারি তহবিল থেকে সরবরাহ করা হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিআরটি ব্যবস্থা চালুতে খুব বেশি কাজের প্রয়োজন হয় না। বিদ্যমান সড়কের দুই পাশে ডিভাইডার (সড়ক বিভাজক) দিয়ে বাসের জন্য পৃথক লেন করলেই চলে। আর বাসে ওঠানামার জন্য কিছু স্টপেজ তৈরি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ভূমি থেকে দুই-তিন ফুট উঁচুতে ছাউনির ব্যবস্থা করতে হয়। বাস স্টপেজের সামনে থামার পর সোজা হেঁটে তাতে উঠে যান যাত্রীরা। আর চলাচলের রুটের মধ্যে কোনো জংশন (মোড়) থাকলে সেখানে বিআরটির বাসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রতিটি মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। বাস মোড়ের কাছাকাছি আসার পর সিগন্যাল বাতি জ্বলে। এতে মোড়ে অন্যান্য যানবাহন বন্ধ করে বিআরটির বাসকে আগে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ফলে বিআরটি নির্মাণে ব্যয় অনেক কম হয়।
যদিও বাংলাদেশে বিভিন্ন মোড়ে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যালের পরিবর্তে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশে বিআরটি নির্মাণ খুবই ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে বলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে বিআরটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। কিন্তু বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বিমানবন্দর সড়ক থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রস্তাবিত বিআরটির জন্য কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে এক কোটি ২৮ লাখ ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১০২ কোটি টাকা। এখন এ ব্যয় আরও বেড়ে হচ্ছে দুই কোটি ৬৪ লাখ ডলার বা ২১৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
বুয়েটের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রথম বিআরটি চালু হয় ব্রাজিলের কুরিতিবা শহরে ১৯৭৪ সালে। ৫৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যবস্থাটি চালু করতে সে সময় ব্যয় হয় আট কোটি ৭০ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতি কিলোমিটারে ব্যয়ের পরিমাণ ১৫ লাখ ডলার। ২০১১ সালে একই শহরে নতুন আরেকটি বিআরটি চালু করা হয়। এতে ব্যয় হয় কিলোমিটারপ্রতি ২৫ লাখ ডলার।
কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোটায় বিআরটি ব্যবস্থা চালু করা হয় ২০০০ সালে। ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ এ প্রকল্পে ব্যয় হয় ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা কিলোমিটারপ্রতি ৫৩ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে ২০০৪ সালে চালু করা সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বিআরটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ কিলোমিটার। এতে ব্যয় হয় প্রায় এক কোটি ৮৭ লাখ ডলার, কিলোমিটারপ্রতি যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭ লাখ ডলার। ব্রাজিলের সাওপাওলোয় ২০০৫ সালে ১১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি বিআরটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩৪ কোটি ২০ লাখ ডলার। কিলোমিটার হিসাবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৩০ লাখ ডলার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালে ইকুয়েডরের কুইটো শহরে ৩৭ কিলোমিটার বিআরটি নির্মাণে ব্যয় হয় দুই কোটি ২২ লাখ ডলার। কিলোমিটারপ্রতি যার পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় লাখ ডলার। এছাড়া ২০১০ সালে তাইওয়ানের তাইপে শহরে বিআরটি চালু করা হয়। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ব্যবস্থা নির্মাণে ব্যয় হয় দুই কোটি ৮৫ লাখ ডলার বা কিলোমিটারপ্রতি পাঁচ লাখ ডলার।
এদিকে নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে ২০১২ সালে আহমেদাবাদে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বিআরটি চালু করেন। এতে ব্যয় হয় ১৪ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। অর্থাৎ প্রতিবেশ দেশটিতেও এ ব্যবস্থা চালু করতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হয়েছে ১৯ লাখ ৩১ হাজার ডলার। আর ২০১৪ সালে ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে ব্রাজিলের পোর্তো অ্যালেগ্রে শহরে ৩৭ দশমিক চার কিলোমিটার বিআরটি চালু হয় গত ১৪ মার্চ। এটি নির্মাণে ব্যয় হয় তিন কোটি ৭৪ লাখ ডলার। কিলোমিটারপ্রতি এর পরিমাণ ১০ লাখ ডলার।
জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক বলেন, আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থায় বিআরটি সবচেয়ে কম ব্যয়সম্পন্ন পদ্ধতি। খুব বেশি জটিলতা না থাকায় খুব দ্রুতই এটি চালু করা যায়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয় ১০ থেকে ৩০ লাখ ডলার। তবে বাংলাদেশে এটা অনেক বেশি হচ্ছে। মূলত অপরিকল্পিত সড়ক ব্যবস্থায় বিআরটি চালু করার কারণেই ব্যয় বেশি পড়ছে।
উল্লেখ্য, বিআরটি চালু করার জন্য গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার বাসের পৃথক লেন, ৩১টি স্টপেজ ও গাজীপুরে একটি বাস টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। কিছু সড়ক প্রশস্ত, সার্ভিস সড়ক ও গাজীপুরে তিন কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি প্রকল্পটির আওতায় আট লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু ও সাতটি মোড়ে ফ্লাইওভার নির্মাণেরও কথা রয়েছে। আর সম্মিলিতভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সওজ, সেতু বিভাগ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)।