চৌচালা টিনশেডের ঘর, পাকা মেঝে, ঘরের ভেতর ছোট্ট র্যাক। র্যাকগুলোয় থরে থরে সাজানো বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস ও কবিতার বই। রয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসসহ হরেক রকমের বই। এ ঘরটিই এখন জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’।
কুষ্টিয়ার খোকসা উপজেলার পাইকপাড়া-মির্জাপুর এলাকার কাঠমিস্ত্রি জসিম উদ্দিন। পড়ালেখা করেছেন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই বইয়ের প্রতি দুর্বলতা আছে তার। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও শিক্ষাকেই জীবন চলার পথের পাথেয় করেছেন তিনি।
বইয়ের প্রতি নিজের আগ্রহের পাশাপাশি জ্ঞান বিস্তারে উদ্যোগী তরুণ তিনি। কাঠমিস্ত্রির কাজ করে যা আয় হয়, তার একটি অংশ তিনি বইপ্রেমীদের জন্য বরাদ্দ রাখেন। নিজের ঘরে ২০১৬ সালের দিকে গড়ে তোলেন ছোট্ট একটি সংগ্রহশালা। গল্প-উপন্যাসসহ প্রায় হাজারখানেক বই রয়েছে এ সংগ্রহশালায়।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অবসর সময়ে এ গ্রন্থাগারে ছুটে আসেন বয়স্করাও। জসিম উদ্দিনের ছোট্ট এ গ্রন্থাগারটি এখন পরিণত হয়েছে পরিপূর্ণ জ্ঞানপিপাসুর আড্ডাখানায়।
নিজে পড়ালেখা করতে পারেননি। তবে এতে তার একটুও আফসোস নেই। কারণ এলাকার মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করবেন বলে জানান জসিম উদ্দিন। এই মহৎ উদ্যোগের সারথি হয়েছেন তার সহধর্মিণী পপি খাতুনও।
গ্রন্থাগারটিকে এখন বড় পরিসরে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন জসিম উদ্দিন। তিনি এখানে হরেক রকমের বইদানের জন্য দেশের বিত্তবানদের কাছে আহ্বান জানিয়ে থাকেন। তার এ ডাকে সাড়াও মিলেছে। অনেকে গ্রন্থাগারটি পরিদর্শন করে বই দিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি বই কেনেন নিজ খরচে। সদস্য সংগ্রহ করেন বিনা পয়সায়। ‘কমিউনিটি লাইব্রেরি’র সদস্য হতে কোনো ফি লাগে না। সদস্যরা নানারকম বই পড়তে পারেন বিনা মূল্যে। ধারও নিতে পারেন। এলাকার পিছিয়েপড়া সব বয়সী মানুষকে বই পড়ার প্রতি উৎসাহ জোগাতেই জসিম এমন উদ্যোগ নিয়েছেন।
জসিম উদ্দিন জানান, আমার বয়স যখন ১০ বছর, তখন আমার বাবা মারা যান। এ বয়সেই সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় আমাকে। বাড়ির পাশের এক কাঠমিস্ত্রির সাহায্যকারী হিসেবে কাজ শুরু করি। সেখান থেকে যা পেতাম, তা দিয়েই সংসার চলত। আমি মাঝে মধ্যে বই সংগ্রহ করে পড়তাম; অন্যকেও পড়তে দিতাম। ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়তে থাকে। এক সময় এ রকম একটা গ্রন্থাগার গড়ার সিদ্ধান্ত নিই। শুরুতে আমার আগের পড়া কিছু বই আর কিছু কিনে প্রায় ১০০-র মতো বই নিয়ে আমার এ গ্রন্থাগারের কার্যক্রম শুরু করি।
অভিভাবকরা মনে করেন, শিশুরা শুধু পাঠ্যবই পড়বে; তবে বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি স্বপ্ন দেখেন, তার পাঠাগারে হরেকরকমের ভালো বই থাকবে, মানুষ বই পড়ার জন্য পাঠাগারে ভিড় জমাবে। মানুষকে বই পড়ানোর ব্যবস্থা করবেন এমন চিন্তা বিরাজ করছিল জসিমের মনের গহীনে। সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। তার বিশ্বাস, গ্রামের কম শিক্ষিত মানুষগুলো বই পড়ার মাধ্যমে অন্য এক উচ্চতায় যেতে পারবে। সে ভাবনা থেকে আজকের এই কমিউনিটি লাইব্রেরি।
জসিম উদ্দিন বলেন, আমি এখন বইয়ের ভিক্ষুক, মানুষ যেন আমাকে বই ভিক্ষা দেয়। গ্রন্থাগারটিতে বসার জায়গা না থাকায় অনেকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বই পড়েন। অনেকে মেঝেতে বসেও পড়েন। এলাকার সব শ্রেণি, পেশা ও বয়সের মানুষ এ গ্রন্থাগারের পাঠক।
বর্তমানে এ পাঠাগারে যারা পড়তে আসেন বা বই ধার নেন, তারা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুব মহিলা, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ যে কেউ এর সদস্য হতে পারেন। তার ভাষায়, শুধু স্কুলের ছেলেমেয়েরাই নয়, যারা উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন, তারাও আমার পাঠাগার থেকে বই নেন। এমনকি বয়স্ক ও সদ্য বিবাহিতরাও বই নিয়ে যান। আমার মতো খেটে খাওয়া মানুষও আসে। এতেই তার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে বলে মনে করেন। তবে এ লাইব্রেরিটিকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে চান তিনি।
খোকসা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. সদর উদ্দিন খান বলেন, ব্যক্তি উদ্যোগে জসিমের কমিউনিটি লাইব্রেরি গড়ে তোলার বিষয়টি প্রশংসনীয়। এ লাইব্রেরির জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত লাইব্রেরির সদস্য বাড়ছে। একজন সামান্য কাঠমিস্ত্রি হয়েও জসিম এখন শুধু শিমুলিয়া গ্রাম নয়, গোটা খোকসা উপজেলার একজন আলোচিত মানুষও।
এসএম জামাল